তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি। পরে বলতে খুব পরে নয়। পনের বছর বয়সেই আমার ভাবনা চিন্তাগুলো অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেক পরিণত আকার নিয়েছে। সেটা সম্ভব হয়েছে সাত বছর বয়সে আমার সত্তার ওপর যে ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল, তারই যন্ত্রণার ফলে।
.
এদিকের ঘরে মা আর আমি শুই। ওদিকের বড় ঘরটায় বাবা থাকে। আমাদের ঘর থেকে বাবার ঘরে যেতে হলে বারান্দা দিয়ে ঘুরে যেতে হয়, কারণ মাঝের দরজাটা বরাবর বন্ধ থাকে। দিনের বেলায় কখনো-সখনো খোলা হয়, তাও বাবা বাড়ি না থাকলে।
ধু-ধু মনে পড়ে, কবে যেন সকলেই আমরা বাবার ওই বড় ঘরে শুতাম। বোধহয় বছর তিনেক আগে পর্যন্ত। মস্ত বড় খাটের একদিকে বাবা শুতো, মাঝে মা আর। মায়ের পাশে আমি। আর মনে পড়ে মায়ের সঙ্গে বাবার প্রায়ই কি নিয়ে যেন ঝগড়াঝাটি কথা কাটাকাটি হত। মা কোনদিনই বেশি কথা বলা বা চেঁচামেচি করার লোক নয়। ঝগড়াঝাটি বাবার সঙ্গে মায়ের ওই এক রাতের আগেও প্রায়ই হয়েছে। আমি কখনো। সভয়ে, কখনো বা সকৌতুকে লক্ষ্য করেছি, বাবা একধার থেকে বকাবকি রাগারাগি। করে চলেছে, মা বেশির ভাগ সময় চুপ–আর তারপর এমন একটা দুটো কথা বলল যে বাবার রাগ মুহূর্তের মধ্যে একেবারে মাথায় উঠে গেল। তখন ডবল গর্জন বাবার। বাবার সেই তর্জন গর্জন দেখলে বা শুনলে ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপতুম আমি। মনে হত, বাবা বুঝি এই মেরেই বসল মা-কে। কিন্তু অবাক লাগত মায়ের মুখের দিকে তাকালে। তার চোখে মুখে ভয়-ডরের লেশমাত্র নেই। বাবার রাগারাগি চেঁচামিচির জবাবে বেশির ভাগ সময় খুব ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে শুধু তাকাতো এক-একবার। অবশ্য সামনে থেকে দেখতাম না, আড়াল থেকে দেখতাম। কারণ ওই ঝগড়ার সময়। আমি কাছে থাকলে মা আমাকে ধমকে তাড়াতো। যাই হোক মায়ের মুখ দেখে এটুকু বেশ স্পষ্ট বুঝতাম বাবার এত রাগারাগি তর্জন গর্জনের মা একটুও পরোয়া করে না। মা এত জোর পায় কোথা থেকে ভেবে অবাক লাগত আমার।
ঠিক কবে থেকে আর কি উপলক্ষে আমি আর মা এই আলাদা ঘরে শুচ্ছি। এখন আর একটুও মনে নেই। বাবার সঙ্গে বাবার ঘরে শুতে হয় না, এটা যেন একটা পরম শান্তির ব্যাপার আমার কাছে। মনে মনে ধারণা, বাবা কি সব বিচ্ছিরি জিনিস খায় আর মুখ দিয়ে গা দিয়ে বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোয়, আর বাবা তখন। যা মুখে আসে তাই বলে গালাগালিও করে, এই সব কারণেই মা আমাকে নিয়ে এই ঘরে সরে এসেছে। আর ওই জন্যেই দুঘরের মাঝের দরজাটা ওইরকম বন্ধ থাকে।
ঘুমাবার সময় মা-কে বিশেষ কাছে না পেলেও মাঝরাত্তিরে অনেক দিনই ঘুম ভেঙে যেত আমার। তখন আবছা অন্ধকারে মা-কে পাশে দেখতাম। এক একদিন উঠে বসে দুচোখ রগড়ে সামনে ঝুঁকে মায়ের মুখখানা দেখতাম। নয়তো ঘুম জড়ানো চোখে সন্তর্পণে মাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু ওই করতে গিয়ে মায়ের ঘুম এক-একদিন ভেঙেও যেত। তখন পাশ ফিরে আমার দিকে শুতো, আলতো করে একখানা হাত আমার গায়ের ওপর ফেলে রাখত। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার কেমন মনে হত, মা-ও যেন একটু একটু বদলাচ্ছে। মনে হত, কবে যেন মা বেশ জোরেই আমাকে বুকে চেপে শুয়ে থাকত। সে-রকম আর হয় না।
একদিনের কথা মনে আছে। ওই রকম ঘুম ভাঙতে উঠে বসে দেখে নিলাম, মা পাশে ঘুমচ্ছে। সেদিন আমার একটু বাড়তি উদ্বেগের কারণ ছিল। সন্ধ্যার পরেই বাবা আর মা-তে তুমুল এক পশলা ঝগড়া হয়ে গেছে। সেদিন শুধু থমথমে মুখ নয়, মায়ের চোখ দুটোও যেন নিঃশব্দে জ্বলতে দেখেছি দরজার আড়াল থেকে। আর বাবাকে চিৎকার করে বলতে শুনেছি, ওই রকম করে চেয়ে থাকলে যাদের টনক নড়ে তাদের কাছে যাও–আমার ওপর ওই কায়দা ফলাতে এলে চোখ দুটো কোনদিন আমি উপড়ে ফেলে দেব, জেনে রেখো! চোখের খেলা দেখাতে এসেছে আমাকে
তারপর থেকে মাকে অনেকবার লক্ষ্য করেছি। ওই কঠিন মুখের দিকে তাকাতে আমারও কেমন ভয়-ভয় করেছে। খানিক বাদে মায়ের কাছে কারা আসতে আমিও যেন একটু স্বস্তি বোধ করেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মা মুখের ওপর আলতো করে একটু পাউডার পাফ বুলিয়ে আর নিজের আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে নীচে নেমে গেল। আমার আশা, বাইরের লোকের সঙ্গে একটু গল্প-সল্প করে মায়ের মেজাজ হয়তো ভালো হবে একটু।
তারপর ওই বেশি রাতে ঘুম ভাঙার আগে মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয় নি। আলো না জ্বেলে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে কোনরকম শব্দ না করেই বিছানায় উঠলাম আবার। তারপর উপুড় হয়ে মায়ের দিকে ঝুঁকলাম, রোজকার মতই ঠাণ্ডা ঘুমন্ত মুখ কিনা দেখব।
আবছা অন্ধকারে একটু চোখ বসতেই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। মা ঘুমোয় নি, আমার দিকে চেয়ে আছে চুপচাপ।–কি দেখছিস?
লজ্জা পেয়ে আমি মায়ের বুকে মুখ গুজলাম। কেন যেন আশা হয়েছিল এভাবে ধরা পড়ার ফলে আমাকে একটু আদর করবে, নিবিড় করবে। কিন্তু মা তা করল না। আবার জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছিলি?
তোমাকে। তুমি আজকাল আর আমাকে আগের মতো ভালবাসো না।
শিথিল দেহ ছড়িয়ে মা শুয়ে আছে। তার একটা হাতও আমার পিঠের ওপর উঠে এলো না। বলল, রাত দুপুরে এখন আর ভালবাসতে হবে না, ঘুমো—
তার বুকের কাছ থেকে মুখ তুলে সোজা হয়ে বসলাম একটু।-বাবার সঙ্গে তোমার এত ঝগড়া হয় কেন? বড় হলে বাবাকে আমি কেটে কুচিকুচি করে ফেলব!