কেন শ্মশানে, শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।
আমি আঁতকে উঠি। পুড়িয়ে ফেলে, মানে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে? লাগে না?
মাসি হাসে। দূর পাগলা, প্রাণ না থাকলে আবার লাগবে কি!
কিছুই বোধগম্য হয় না, অস্বস্তি বাড়তে থাকে। মরে গেলে সব্বাইকে পুড়িয়ে ফেলা হয়?
পুড়িয়ে না ফেললে শরীরটা পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবে না!
এই চিন্তাটাই মাথার মধ্যে অনেক দিন পর্যন্ত ঘুরপাক খেয়েছে আমার। মৃতদেহের এই শেষ গতি মনঃপুত হয়নি একটুও। পরিচিত মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, বিশেষ করে রাতে বিছানায় গা ঠেকালে। মায়ের মুখ, বাবার মুখ, মালতী মাসির মুখ, স্কুলের ছেলেদের আর মাষ্টারদের মুখ, নিজের মুখও। সক্কলের জ্বলন্ত দেহ আমি কল্পনায় দেখে আঁতকে উঠেছি, নিজেরটা আর মায়েরটা সব থেকে বেশি দেখেছি। দৃশ্যটা ঠেলে সরাতে চাই অথচ সরে না।
এই মালতী মাসির কল্যাণেই ক্রমশ পূর্বজন্ম ইহকাল পরকাল সম্পর্কে আমার বেশ জ্ঞান লাভ হয়েছে। এই তিনকালের যাবতীয় কিছু যেন চোখের সামনে তার। যেমন আমরা সব এক ধার থেকে জন্মে জন্মে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত যে কত ঘরে কতবার জন্মেছি তার ঠিক ঠিকানা নেই। পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত শুনতে মজাই লাগত। চোখের সামনে যত লোক দেখছি তাদের মধ্যে কত জনে কোন জন্মের বাবা ছিল বা মা ছিল বা ভাই ছিল বা বোন ছিল তার ঠিক আছে! অথচ এমনই মজা যে কেউ কাউকে চিনতেও পারছি না।
হঠাৎ বুকের তলায় মোচড়ও পড়েছিল একটা। সেই যে রাস্তার ভিখিরিগুলো খাবার জন্য পয়সা চেয়েছিল আর মা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল, এমন যদি হয় ওদের মধ্যে কেউ একজন পূর্বজন্মে আমার মতই মায়ের ছেলে ছিল, তাহলে? সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে কে যেন চিন্তাটাকে পূর্বজন্ম থেকে এই জন্মেই ঠেলে নিয়ে। এলো। আমি যদি না খেয়ে অমনি যন্ত্রণা পেতে থাকি, মা কি করে?… আ-হা এমন যদি হয়, আমি না খেয়ে আছি আর মা সেটা জানতে পারছে। আশ্চর্য মায়ের সেই ছটফটানি কল্পনায় দেখে আমার এমন আনন্দ হয়েছিল কেন!
এ-জন্ম সম্পর্কে মালতী মাসির বক্তব্য, ভালো হয়ে থাকতে হয়, ভালো চিন্তা করতে হয় আর সর্বদা লোকের উপকার করতে হয়–তাহলেই পরের জন্মে আর সুখের অন্ত থাকবে না। শয়তান লোকেরা মরে গিয়ে ভূত হয়, তারপর ভগবানের কাছে সাঙ্ঘাতিক সব শাস্তি পায়। কাউকে আগুনে পোড়ানো হয়, কাউকে ফুটন্ত তেলে ভাজা হয়, কাউকে মলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয় আর কাউকে বা করাত দিয়ে কাটা হয়। শাস্তির শেষে আবার তারা হঁদুর বেড়াল শেয়াল কুকুর হয়ে জন্মায়।
এ-জন্মের সঙ্গে পরের জন্মের যোগ। তাই এ-জন্ম নিয়েও আমার দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। নিজের কোনো কাজের মধ্যে তেমন ভালো কিছু চোখে পড়ত না, আর কিছু একটা অন্যায় করে বসলে তারপর পরের জন্মের শাস্তির কথা মনে হলে বস্তুর মতো ভাবনা ধরে যেত। কুকর্মের কথা মাসিকে চুপিচুপি বলে জিজ্ঞাসা করতাম, পরের জন্মের আগে খুব শাস্তি পাব, তাই না। মাসি সর্বজ্ঞের মতই অম্লান বদনে অভয় দিত তখন। বলত, দোষ করে স্বীকার করলে আর পাপ থাকে না।
ফলে অন্যায় কিছু করলে (আমার মতে হামেশাই করতাম) কোনো এক ফাঁকে মালতী মাসির কাছে অন্তত সেটা স্বীকার করতাম।
যাক, এই শিক্ষাগুণেই মাঝে মাঝে আমার মনে হত পূর্বজন্মের এক একটা দৃশ্য। যেন আমি হঠাৎ দেখতে পাই। তন্ময় হয়ে দেখি-ও। দেখি, ছোট্ট তিন বছরের একটা ছেলেকে সামনে বসিয়ে মা আদর করে তার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, সাজিয়ে দিচ্ছে, তারপর আদর করে চুমু খাচ্ছে, দুষ্টুমি করলে বকছে আবার আদর করে বুকে টেনেও নিচ্ছে তক্ষুনি। আদরে আদরে সেই ছোট্ট ছেলেটা যেন ভরাট হয়ে আছে! এরকম কত কি স্বপ্ন দেখি।
মাসি শুনে হেসে বাঁচে না। বলে, পূর্বৰ্জন্ম কি রে, এ-সব তো এ-জন্মেরই কথা তোর! কি ভালই না বাসত তোকে, শুটিং-এর পর বাড়ি ফিরে মা তোর পাঁচ মিনিটও তোকে ছেড়ে থাকতে চাইতো না। সন্ধ্যা আর রাত্তিরেও তো হামেশা লোকজন আসত দেখা করতে, তাই তোকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েই যেত এক একদিন–বাবু মাঝে মাঝে সে-জন্য কম রাগ করত!
আমি লালায়িত হয়ে শুনতাম। বাবা কেন রাগ করত বুঝতাম না কিন্তু বাবার রাগের কথা শোনামাত্র তার ওপর কেমন একটা নির্মম প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করত। মায়ের আদরে আদরে আমার সেই ভরাট চিত্রটা এ-জন্মেবই ব্যাপার, এ যেন সহজে বিশ্বাস হত না। আবার অবিশ্বাসই বা করি কি করে। সেই মিষ্টি মিষ্টি মায়ের মুখখানা তো অবিকল এই জন্মের মায়ের মুখের মতই!
নদশ বছরের সেই ছোট ছেলেটার বুকের তলায় সে-কি যন্ত্রণা! দুবছর আগে মা এ-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পূর্বজন্মের ভেবে যে চিত্রটা দেখতাম সেটা কত আর আগের? এত ভালোবাসত যে মা, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল কেন? যেতে পারল কি করে?
কেন গেল, যেতে পারল কি করে, আমি জানি। মালতী মাসি মায়ের থেকেও কম করে তিন বছরের বড়। মনে হয় তার বুকের তলায়ও অনেক ক্ষোভ অনেক যন্ত্রণা অনেক বাসনা পুঞ্জীভূত ছিল। মা চলে যাবার পরেই তাকে আমি কাছে পেয়েছি, এত কাছে বোধহয় জীবনে আর কাউকে পাই নি। আমার তেরো বছর বয়সের সময়ও সে আমাকে হঠাৎ-হঠাৎ এক-একদিন বুকে টেনে নিয়ে এমন আদর করা শুরু করত যে আমার ভয়ানক লজ্জা করত। তেরো বছর বয়সে ওই মালতী মাসিকে আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত মালতী মাসির সব থেকে কাছের জীবিত প্রাণী আমি। বুঝি না বুঝি, ফাঁক পেলেই অনর্গল গল্প করত আমার সঙ্গে। বেশির ভাগই নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলত, মায়ের আর বাবার গল্প করত। পরে, অনেক পরে মনে হয়েছে, ওই রকম গল্প করে করে মাসি তার নিজের ক্ষোভ-আর যন্ত্রণা হাল্কা করত। আর মনে হয়েছে, ধাপে ধাপে মা কি করে অত বড় আর্টিস্ট হয়ে উঠল, সেই গল্প যে করত তাও মাসির নিজের অপূর্ণ বাসনার একটা বিপরীত দিক, নইলে ওই বয়সের ছেলের কাছে মায়ের বড় হবার চিত্রটা অমন প্রত্যক্ষ গোচর করে তোলার কথা নয়। অনেক কিছুই বুঝতাম না তখন কিন্তু আমার শোনার আগ্রহ থেকে মাসির বলার আগ্রহ কিছুমাত্র কম মনে হয় নি।