বিমনা হওয়ার দরুন মাষ্টারমশাইদের বকুনি খাই। বাড়ি ফিরে মালতী মাসিকে না দেখা পর্যন্ত সেই অস্থিরতায় বুকটা সর্বক্ষণ ধুকপুক করতে থাকে।
অথচ আশ্চর্য, রাগকে ভয় করি, রাগকে ঘৃণা করি, কিন্তু কারণে অকারণে রাগ বোধহয় আমারই সব থেকে বেশি হয়, বাবার ওপর রাগ। হঠাৎ একদিন রাত থেকে আর তারপর দিনের পর দিন ধরে যাকে আর বাড়িতে দেখলাম না তার ওপর রাগ, মালতী মাসির ওপর রাগ, নিজের ওপর রাগ, এক এক সময় দুনিয়ার সকলের ওপর আর সকল কিছুর ওপর রাগ। দিনের পর দিন ওই রাগের প্রকোপ আমার মধ্যে বেড়েই চলেছে, প্রকাশ না করে সেটা হজম করে ফেলতে চেষ্টা করার দরুন কষ্টটাও বেড়েই চলেছে। সেও আমার নিজস্ব একেবারে একলার কষ্ট, কেউ টের পায় না।
আমার অনেক কিছু জ্ঞান আর ধারণার গুরু মালতী মাসি। আমি তাকে সবজান্তা ভাবতাম। পূর্বজন্ম ইহকাল পরকালের সমাচার তার কাছ থেকেই জেনেছি। আমার মনের তলায় কত সময় কত রকমের উদ্ভট প্রশ্ন জাগত ঠিক নেই। শিশুকাল থেকে শহরের এক অভিজাত এলাকায় বাস আমাদের। ছবির মতো সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি। আশপাশে যারা থাকে তারাও রীতিমতো সভ্যভব্য। এর মধ্যে কয়েক ঘর মাত্র বাঙালি, বেশির ভাগ বাসিন্দারা নানা রাজ্যের পয়সাঅলা মানুষ। তাই ঠিক বাড়ি বসে সর্বসাধারণের বাস্তবরূপ বা বাস্তব জীবন-যাপনের চিত্র খুব বেশি দেখতে পেতাম না। মাঝে সাজে বেড়াতে বেরিয়ে বা স্কুলে যাওয়া আসার সময় যেটুকু দেখতাম, তাই এক এক ধরনের কৌতূহলের উদ্রেক করত।
মনে আছে, মায়ের সঙ্গে এক বিকেলে গাড়ি করে যাচ্ছিলাম কোথায়। পুলিশ হাত দেখানোর দরুন গাড়িটা থেমে গেছে। সামনে পর পর অনেকগুলো গাড়ি। চেয়ে দেখি ফুটপাথের ওপর শুয়ে আছে কতকগুলো নোংরা ছেলে মেয়ে আর বউ। আমার। মতো বয়সের হদ্দ কুচ্ছিত ছেলেও আছে দুটো। আর কয়েকটা মানুষ খালি গা, পরনে নোংরা খাটো ধুতি, গাড়িগুলোর সামনে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষে চাইছে।
আমাদের গাড়ির সামনের বুড়ো মতো লোকটা মায়ের সামনে হাত পেতে করুণ সুরে পয়সা চাইতে লাগল, আর কত কি বলতে লাগল।
মা-গো, এই ছেলেমেয়েগুলোর দিকে চেয়ে দেখুন, সমস্ত দিন কিছু খায় নি মা, চার আনা পয়সা ওদের মুখ চেয়ে দিয়ে যান মা, খিদের জ্বালায় মরে যাচ্ছি। মা-গো, মা মাগো মা মা
গাড়িটা চলতে শুরু করার পরেও লোকটা মা মা করে খানিক এসে তারপর থেমে গেল।
আমি অবাক বিস্ময়ে একবার ওই লোকটাকে দেখছিলাম আর একবার মা-কে দেখছিলাম। গম্ভীর বিরক্তিতে মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল।
আমার ঠিক ছবছর বয়েস তখন। এরমধ্যে কত সময় মাকে কত কি দিতে দেখেছি লোককে, অথচ এত কাকুতি মিনতি শুনেও মা অমন নির্বাক থাকল কি করে, আমার কাছে সেটাই বিস্ময়।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মা ওই লোকটা পয়সা চাইহিল কেন?
মা ছোট জবাব দিল, ভিক্ষে করছিল।
ভিক্ষে করছিল কেন?
খেতে পায় না বলে।
খেতে পায় না কেন?
খাবার কেনার পয়সা নেই বলে।
তোমার কাছে তো পয়সা আছে, অত করে চাইল, তুমি দিলে না কেন?
মা এবারে বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল, চুপ করে বসে থাকো!
খানিক বাদেই আবার আর এক কাণ্ড দেখলাম। তখনো ভিড়ে আমাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেছে। পাশের ফুটপাথ ঘেঁষে কতকগুলো লোক আর একটা লোককে খাটে শুইয়ে। বিকট স্বরে বলো হরি, হরি বোল বলো-ও হরি, হরি বোল বলে চিৎকার করতে করতে চলেছে। মা-ও একবার তাকালো সেদিকে, তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
আমি শুনেছিলাম, কেউ মরে গেলে তাকে ওভাবে খাটে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে গিয়ে কি করা হয়, জানি না।
জিজ্ঞাসা করলাম, মা খাটের ওই লোকটা মরে গেছে?
লোকটা মরে কোথায় যাচ্ছে?
হরি ঠাকুরের কাছে!
ওই লোকগুলো ওভাবে চেঁচাচ্ছে কেন?
হরিনাম শোনাচ্ছে।
হরিনাম এরকম বিচ্ছিরি কেন?
মায়ের আবার ধমক, চুপ করে থাকো।
কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা গেল না। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, যে মরে গেছে, ওই লোকেরা তাকে হরি ঠাকুরের কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে?
হু।
হরি ঠাকুর কোথায় থাকে?
স্বর্গে।
এরোপ্লেনে করে নিয়ে যাবে?
চুপ করবি তুই, না কি? কেবল বকর-বকর, বকর-বকর
দুকথার পর তিন কথাতেই মা অমনি করে ধমকে থামিয়ে দিত আমাকে। কিন্তু মালতী মাসি ঠিক উল্টো তার। প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়ে আমার হাজারো রকমের কৌতূহল মেটানোর ব্যাপারে তার ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। বাবার সঙ্গে রাগারাগি করে মা ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে মালতী মাসি প্রায়ই আমার ঘরে শোয়। বাবা টের পেলে রেগে যাবে সেই ভয়ে নিজের চৌকিটা এ-ঘরে নিয়ে আসে না, আমি ঘুমিয়ে পড়লে মেঝেতে শোয়। এক একদিন আবার নিজের ঘরে চলে যায়। মোট কথা ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি তাকে কোনদিন ছাড়ি না। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে মালতী মাসির বুক ঘেঁষে শুয়ে গল্প শোনাটা আমার একটা নেশার মতো হয়ে উঠেছিল। এর ব্যতিক্রম হলে কিছুতে ঘুম আসত না, অনেক রাত পর্যন্ত ছটফট করতাম।
মানুষ মরে গেলে স্বর্গে হরি ঠাকুরের কাছে কি করে যায়, সেই কৈৗতূহল মালতী মাসিই মেটাতে চেষ্টা করেছে। শরীরের মধ্যে নাকি আত্মা থাকে, সে যায় হরি ঠাকুরের কাছে।
মড়া নিয়ে যাবার দৃশ্য আমি তার মধ্যে আগে দুই একটা দেখেছি। হরি বোল করতে করতে শরীরটাকে ওই লোকগুলো তাহলে কোথায় নিয়ে যায়?