খুব ভালো।
হু, তোর ভালো আমি জানি না, কালই হয়তো কাগজে দেখব হুল ফুটিয়ে চিঠি লিখেছিস।… কোথায় বসেছিস, ঠিক মতো দেখতে শুনতে পাচ্ছিস তো?
মোটামুটি। দুটাকার পেছনের দিকের সীট, কথা কিছু কিছু মিস হবেই।
চকিতে আমার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিল একবার। পরনের জামা কাপড় ধোপ দুরস্ত নয় তেমন। পলকের ভ্রূকুটি। আমার ঠাণ্ডা মূর্তিও হয়তো চোখে শুকনো শুকনো ঠেকল। খাবি কিছু?
হাত দুটোকে সংযত করার জন্যই পকেটে ঢোকালাম। ঠোঁটে হাসি টেনে আনার চেষ্টাটা সেদিন এমন শক্ত লাগছিল কেন, জানি না। তবু চেষ্টার কসুর করিনি। পিছনের। আধখানা আড়ালে দাঁড়িয়ে যশোদাও আমাকে দেখছিল। আমার মধ্যে সর্বদাই ও যেন। দেখার খোরাক পয় কিছু।
মাথা নাড়লাম, খাবার বাসনা নেই।
পরের অঙ্কের প্রথম ঘণ্টা বাজল। বিপাশা দেবী ঈষৎ ব্যস্ত গাম্ভীর্যে ঘর থেকে আধা-আধি বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। ফলে আমার গায়ের সঙ্গে তার গা ঠেকল।
এই মুহূর্তে ওই স্পর্শটুকু আচমকা নিষ্ঠুরভাবে নিবিড় করে ফেলতে পারি, অবাধ্য হাত দুটোকে স্বাধীনতা দিতে পারি।… তারপর কে থাকবে? বিপাশা দেবী, না চক্রের অন্তঃপুর-সীমন্তিনী, না আর কেউ?… মা ইন্দুমতী থাকবে বোধহয়, একটা দুর্বার লোভ দমন করে হাত দুটো শক্ত করে পকেট দুটোর মধ্যে আটকে রাখলাম।
দুদিক থেকে দুটো লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো একসঙ্গে। চক্রের এই নায়িকার হাতে তাদেরও দণ্ডমুণ্ডের চক্র যেন।
একে একেবারে প্রথম রো-তে বসিয়ে দিন তো।
লোক দুটোই মাঝখান থেকে আচমকা বিপাকে পড়ল যেন। মুখ কাচুমাচু করে একজন বলল, প্রথম দিনের প্রথম শো, হাউস একেবারে প্যাক্ট আপ…
শোনামাত্র মুখে বিরক্তির আভাস। কিন্তু সেও অশোভন মাত্রায় নয়।–যা বললাম ব্যবস্থা করুন, দরকার হলে এক্সট্রা চেয়ার দিন! আমরা দিকে ঘুরল। ঈষৎ তপ্ত একটা নিঃশ্বাসের স্পর্শ মুখে এসে লাগল।
এদের সঙ্গে যা। শো-এর শেষে দেখা না করে পালাস না যেন!
ভিতরে ঢুকে গেল। দ্বিতীয় বেল বেজে উঠবে এক্ষুণি।
অসুবিধের কথা বলে ফেলে লোক দুটো আরো বেশি বিব্রত যেন। তাদের একজন। সবিনয়ে ডাকল, আসুন স্যর–উইং-এর বাইরে আসতে আসতে আবার বলল, কিছু মনে করবেন না স্যর, এক্সট্রা চেয়ার যে কত পড়ে গেছে, উনি তো জানেন না…
বললাম, ব্যস্ত হবেন না, কিছু দরকার নেই।
না না না, তা কি হয়! উনি আদেশ করেছেন যখন, কে আর কি বলবে, আপনি আসুন!
মুখ দেখে মনে হল, তার সঙ্গে সম্মানের আসনে গিয়ে না বসলেই বরং লোকটা বিপদে পড়বে। আলো নিভতে শুরু করেছে। শশব্যস্ত তৎপরতায় অনেকের অসন্তোষ উপেক্ষা করে একেবারে সামনের সারির দুই রো-র ফাঁকে চেয়ার পেতে বসিয়ে দিল আমাকে।
ড্রপ সীন ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় নাটক আবার জমে উঠল। আখ্যানের নায়ক নায়িকা এক অমোঘ পরিণতির দিকে বেগে ছুটেছে। নায়িকার বুকের তলায় এবার এক আপোসশূন্য নিষ্পত্তির আগুন জ্বলে উঠেছে। ফলে দর্শকের চোখে আরো দৃপ্ত, আরো মহীয়সী হয়ে উঠেছে সে।
কিন্তু আমার ভিতরের সুরটা কেটে গেছে। দুই অঙ্কের সেই জমাট-বাঁধা মানসিকতা থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। স্টেজের গা-ঘেঁষা চেয়ারে বসে আমিই শুধু উসখুস করছি।
ঠিক সেই মুহূর্তটাই আমি বেছে নিলাম। যে মুহূর্তে নায়িকা তার চরম ঘোষণাটি জ্বলন্ত আগুনের মতো ভ্রষ্ট নায়কের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে স্টেজের একেবারে সামনে দর্শকদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তার পিছনে ভ্রষ্ট নায়কের স্তব্ধ ভয়াল মূর্তি, পাদপ্রদীপের সামনে পাষাণ-স্ফুলিঙ্গ রমণীর মূর্তি, তার সামনে দুরুদুরু বক্ষ মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক। ঠিক ওই মুহূর্তটি বেছে নিয়েই আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আশপাশ থেকে আর পিছন থেকে বিরক্তিসূচক চাপা শব্দ উঠল একটা। এভাবে উঠে দাঁড়িয়ে যা আশা করেছিলাম তাই অবধারিতভাবে ঘটল। পার্ট ভুলে, স্থান-কাল ভুলে ওই অনন্যা নায়িকা বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। সম্ভব হলে সেও আমাকে বাধা দিত, বসতে বলতো।
কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নির্লিপ্ত মুখে আবছা অন্ধকার পেরিয়ে আমি দরজার দিকে এগোলাম।
পরদিনের কাগজে চক্র নাটকের প্রথম দিনের প্রথম অভিনয় প্রসঙ্গে সাড়ম্বর প্রশংসা ছাপা হল। প্রশংসা অভিনেত্রী বিপাশা দেবীরই বেশি। কিন্তু তার মধ্যে দুটো কাগজ অন্তত লিখেছে, দ্বিতীয় অঙ্কের গোড়ার দিকে নাটকের সঙ্কটমুহূর্তে স্বনামধন্যা শিল্পীর অভিনয়ে স্বল্পক্ষণের জন্য অন্তত কিছু ত্রুটি দেখা গেছল। তখন দুই-একবার তার পার্টও ভুল হয়েছিল, যা কখনো হয় না। অবশ্য পরের অভিনয়ে সেই টিটুকু তিনি পুষিয়ে দিতে পেরেছেন।
***
আমি কি জাতিস্মর? চোখ বুজে তন্ময় হলে পূর্বজন্মের দৃশ্য দেখতে পাই?
চোখ বুজে তন্ময় হওয়ার ধাতটা আমার নবছর বয়েস থেকেই। কত সময় মালতী মাসি ঠেলা মেরে সেই তন্ময়তা ভঙ্গ করেছে। মনে মনে মালতী মাসির ওপর রেগে আগুন হয়ে গেছি। অথচ মুখে কিছু বলতে পারি নি। সেইজন্যই রাগ হলে আমার কষ্ট আরো বেশি হত। আমার ধারণা নিছক একটা রাগারাগির ফলে একজনকে হারিয়েছি। সেটা বাবা আর মায়ের রাগারাগি। সেই থেকে জিনিসটাকে আমি বিলক্ষণ। ভয় করি। বাবা যখন মালতী মাসিকে রাগের সুরে কিছু বলে তখনো ভিতরে ভিতরে আমার কেমন কাঁপুনি ধরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মালতী মাসির পিছনে তখন ঘুর ঘুর করি। স্কুলে বসেও সেদিন মালতী মাসির জন্য ভিতরটা উদ্বেগে অস্থির হয়ে পড়ে কেমন। কেবলই মনে হয়, বাড়ি ফিরে যদি দেখি, মালতী মাসিও আর নেই?