রাতে ঘুমের ওষুধের ঘোরে জগৎ মিত্র বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। চোখ মেলে তাকাতেই মাথার পাশের চেয়ারে যাকে দেখল সে স্বপ্ন না সত্যি–হঠাৎ ভেবে পেল না।
রত্না। সে চোখ মেলে তাকাতে চেয়ারটা আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে এলো।
দুজনে দুজনার দিকে চেয়ে আছে।
দ্বিতীয় বাসর এখানেই শেষ।
চেয়েই আছে।
.
মোহিনী সরকারের বলার ফাঁকে তার গেলাসের শেষের হাফ শেষ। আর মহাদেব গাঙ্গুলির তৃতীয় গেলাসও শেষ। তিনি বললেন, আপনি তো খুব মন দিয়েই গল্পটা পড়েছেন দেখছি।
মোহিনী সরকার এখন একটু মেজাজে আছেন। ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, তাতে কি প্রমাণ হল?
-কিছু না। মহাদেব গাঙ্গুলির গম্ভীর দুচোখ এবার বিভা সরকারের দিকে। গল্পটা আপনার গাঁজাখুরি মনে হয়েছে?
একটু ইতস্তত করে বিভা সরকার জবাব দিলেন, উনি যে-রকম বলছেন, সে রকম নয়। পড়তে তো আমার বেশ ভালোই লেগেছে।… তবে আপনার অন্য বইয়ের মতো অতটা বাস্তব নয়।
-কোন কোন জায়গা অবাস্তব?
বিভা সরকার একটু ফাঁপরে পড়লেন। আগ বাড়িয়ে জবাব দিলেন মোহিনী সরকার। বললেন, আপনি সত্যি বড় লেখক, কিন্তু এই গল্পের কোথায় অবাস্তব আপনার সত্যি চোখে পড়ছে না? এই গল্পের ভিতটাই তো অবাস্তব। বিবাহিত জগৎ মিত্রর ওভাবে এক মেয়ের পাল্লায় পড়া অবাস্তব, রত্নার মতো বউকে ছেড়ে তাকে বিয়ে করা অবাস্তব, সব থেকে বেশি অবাস্তব আপনার কলমের খোঁচায় রত্নাকে আই-এ, বি-এ, এম-এ ভালভাবে পাশ করিয়ে প্রোফেসারির চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া-সেদিক থেকে রবিঠাকুরের সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার কল্পনাকে আপনি হার মানিয়েছেন–তারপরে বিরহী নায়কের হিমালয় ভ্রমণ অবাস্তব, অ্যাকসিডেন্ট এত মামুলি বলেই অবাস্তব –মিলনও অবাস্তব। এ সবই লেখকের ইচ্ছেয় হয়েছে।
-বুঝলাম। গম্ভীর মুখে সামান্য মাথা নেড়ে মহাদেব গাঙ্গুলি সায় দিলেন!… মা গঙ্গার আশীর্বাদের অমোঘ ফল বুঝতে পারছি। নড়েচড়ে সোজা হলেন একটু। দুচোখ সোজা নিজের স্ত্রীর মুখের ওপরে।-তুমি কি বলো?
অন্য দুজনের এবার খেয়াল হল, সোমা গাঙ্গুলির সমস্ত মুখ টকটকে লাল। ওই মুখে কেউ যেন হালকা করে আবির গুলে দিয়েছে। আগেও মাঝে মাঝে ওই মুখের ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন দুজনেই। তাই তারা অবাকই একটু।
সোমা গাঙ্গুলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ওদের দুজনের দিকে চেয়ে তেমনি আরক্ত মুখে বললেন, উপন্যাসের সব জায়গায় গায়ক আর গান বদলে লেখক আর লেখা করে নিন, রেকর্ড কোম্পানীর জায়গায় পাবলিশার করুন, ছবির গানের জায়গায় রেডিওর গল্প পড়া করুন–আর… আর (মুখ আরো লাল) নায়ক-নায়িকার নাম দুটো শুধু বদলে নিন–তাহলে কিছুই অবাস্তব নয়–সবই ঘটেছে।
বলতে বলতে সোমা গাঙ্গুলি ঘর ছেড়ে দ্রুত বারান্দায় চলে এলেন।
মোহিনী সরকার আর বিভা সরকারের অবাক দৃষ্টি প্রথমে বারান্দার দিকে। তারপর হতভম্ব বিমূঢ় চোখে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল।
সদা-গম্ভীর মহাদেব গাঙ্গুলির ঠোঁটের ফাঁকে টিপটিপ হাসি।