এক রবিবারে সেখানে গেল। নীচে রত্নার সেই মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। জিগ্যেস করল, রত্না এখানে?
বিরস মুখে সে মামাতো ভাই মাথা নাড়ল। এখানেই।
-কোন কলেজে পড়ছে?
কোন কলেজে বলল।
-একবার ডেকে দিতে হবে। তার খরচপত্র চালানোর দায়িত্ব আমার। সে-সম্পর্কে কথা বলব।
সে চলে গেল। মিনিট তিনেকের মধ্যে ফিরেও এলো।রত্না বলল, তোমার কোনো দায়িত্ব নেই। তাই দেখা করারও দরকার নেই।
দিন যায়। জগৎ মিত্রর ভিতরটা দিনে দিনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। আর সুমিত্রার ততো মোহ ভাঙছে। তার ইচ্ছেয় লোকটার ছবিতে গান গাওয়া, রেকর্ড করা, সভায় গাইতে যাওয়া, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, ওঠা-বসা-চলা-ফেরায় বাধা আসতে পারে এ তার কল্পনার বাইরে। কিন্তু ক্রমে সেইরকমই ব্যাপার দাঁড়াতে লাগল। ফলে একতরফা ঝগড়াঝাটি আর শাসনও বাড়তেই থাকল। সে-ও মেয়েই। মেয়েলি অনুভূতিতে সন্দেহের আঁচড় পড়তে লাগল। বিয়ের পর থেকেই লোকটাকে অন্যরকম দেখছে, বদলে যেতে দেখছে। তার সন্দেহ, এই লোকের মন আর একদিকে পড়ে আছে। তাহলে সেটা আগের বউ ছাড়া আর কার দিকে হবে? নইলে বিয়ের পর থেকেই এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? এই সন্দেহ মনে এলেই সুমিত্রা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যা মুখে আসে তাই বলে। গালাগালি করে। অন্যদিকে মুখে রা নেই। তার কানে তুলো, পিঠে কুলো। কিন্তু সে যেমন চলছে, তেমনই চলছে।
মোহ-একেবারেই ছুটে গেল, বা আচমকা জগৎ মিত্রই ছুটিয়ে দিল ন মাসের মাথায়। সুমিত্রার শাসন আর আগের বউ নিয়ে ঠেস সেদিন মাত্রা ছাড়িয়েছে। তার ওপর দিয়ে জগৎ মিত্র হঠাৎ গর্জন করে উঠল। বলল, তুমি আমার সর্বনাশ করেছ–বুঝলে? এত বড় সর্বনাশ কেউ কারো করে না–যার কাছ থেকে তুমি আমাকে। ছিনিয়ে এনেছ তুমি তার পায়ের নখের যোগ্যও নও-বুঝলে?
বোঝার সেখানেই শেষ। সুমিত্রার বাবা তাকে কেবল গলাধাক্কা দিয়ে বার। করতে বাকি রেখেছেন। আর শাসিয়েছেন, বিয়ে ভাঙিয়ে ফের বিয়ে করার জন্য তিনি তাকে জেল খাটাবেন–আর মেয়ের খোরপোষ আদায় করে তাকে ফতুর করবেন।
শেষ পর্যন্ত কিছুই করেন নি। মেয়ে রেজিষ্ট্রি বিয়ে নাকচের ডিভোর্স সুট ফাইল করেছে। তাতে অনেক অত্যাচার, অসদাচরণের অভিযোগ। জগৎ মিত্র কনটেস্ট করা দূরে থাক, কোর্টে পর্যন্ত যায় নি। তারা একতরফা ডিক্রি পেয়েছে।
জগৎ মিত্র মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে।
আরো মাসখানেক অপেক্ষা করে রত্নাকে একখানা চিঠি লিখেছে। তার প্রায়শ্চিত্তের কথা লিখেছে। মুক্তির কথা লিখেছে আর একটিবার দেখা করার অনুমতি ভিক্ষে করেছে।
– চিঠির জবাব মেলে নি।
আরো পনের দিন পরে তাকে কলেজে যাবার পথে ধরেছে। রত্না আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চোখে চোখ রেখে অনুচ্চকঠিন গলায় বলেছে, আর কখনো এ-ভাবে থামালে রাস্তার নোক ডাকতে হবে।
চলে গেছে।
একে একে বছর ঘুরেছে। একটা, দুটো করে ছটা। প্রতিবারের পরীক্ষার ফল বেরুলে জগৎ মিত্র গেজেট দেখেছে। রত্না মিত্র আই-এ পাশ করল, ইংরেজিতে ভালো অনার্স পেয়ে বি-এ পাশ করল, তারপর ইংরেজিতেই ভালোভাবে এম-এ পাশ করল। এখন সে একটা নতুন বেসরকারী মেয়েকলেজে ইংরেজি পড়ায়। জগৎ মিত্রর বয়েস একত্রিশ-রত্নার সাতাশ।
জগৎ মিত্র একটাই আশা বুকে ধরে নিয়ে বসে আছে। রত্নার নামের পরে এখনো মিত্র চলছে, মিত্র বাতিল করে এখনো বাপের পদবী বসুতে ফিরে যায় নি। আর সেই যে রাস্তায় দেখা হয়েছিল তখনো সিঁথিতে খুব সূক্ষ্ম সিঁদুরের আঁচড় দেখেছিল। জগৎ মিত্র গান ছাড়ে নি। গান নিয়ে আছে। নাম ডাকও হয়েছে। রেকর্ডের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়ছে। রোজগার ভালো। কিন্তু তার গানের ধারা বদলেছে। যে গানের স্পর্শ প্রাণের গভীরে পৌঁছয় সেই গানই শুধু গায়। রেকর্ডে, রেডিওয়, উৎসব-অনুষ্ঠানেও তাই। সিনেমায় হালকা চটুল গানের ডাক পড়লে বাতিল করে দেয়।
এইবার সে শেষ চেষ্টার জন্য প্রস্তুত হল। রত্নার কলেজে গেল। দারোয়ানের হাত দিয়ে একটা স্লিপ পাঠালো। স্লিপে শুধু নিজের নাম। তারপর অফিসঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
মিনিট পাঁচ-সাত বাদে হিন্দুস্থানী দারোয়ান সেই স্লিপটাই তার হাতে দিল। ভাঁজ খুলে দেখল, উল্টোদিকে লেখা, দেখা হবে না।
জগৎ মিত্র চলে এলো। তার প্রতীক্ষার শেষ। আশারও।
পরের টানা নয় মাসের মধ্যে জগৎ মিত্রর আর কেউ দেখা পেল না। উৎসব অনুষ্ঠান, রেডিও, রেকর্ড, সিনেমা–সর্বত্র সে অনুপস্থিত। রেডিও-শ্রোতার সন্ধিৎসু চিঠির জবাবে সেখানকার কর্মীরা বেতারেই শ্রোতাদের জানাচ্ছে, জগৎ মিত্র দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বলেই দীর্ঘদিন ধরে তাঁর গান বেতারে শোনা যাচ্ছে না। সিনেমার পত্র পত্রিকাগুলোতেও জগৎ মিত্রকে নিয়ে কিছু জল্পনা-কল্পনা চলেছে।
নমাস বাদে একদিন কলকাতার সব কাগজে বড়বড় হরফে খবর বেরুলো সঙ্গীতশিল্পী জগৎ মিত্রর সন্ধান মিলেছে। দীর্ঘদিন ধরেই তাকে হিমালয়ের দূর-দুর্গমের নেশায় পেয়েছিল। চরৈবেতির ডাক শুনে মুসাফিরের মতো তিনি মাসের পর মাস পাহাড়ে ঘুরেছিলেন। এবারে যমুনোত্রী থেকে ফেরার পথে তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে গুরুতর আহত হন। আশংকাজনক অবস্থায় তিনি এখন দেরাদুন হাসপাতালে।
খবর মিথ্যে নয়! জগৎ মিত্র সব থেকে বেশি চোট পেয়েছিলেন মাথায়। দেরাদুনের ডাক্তাররা সেই কারণেই অবস্থা আশংকাজনক ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য দুদিন বাদে তারা ফাড়া কাটার কথাও বলেছেন।