আট দিনের দিন রেজিষ্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল।
তার দু-দিন বাদে রত্নাকে রেজিষ্ট্রি চিঠি পাঠালো একটা। আর কারো হাতে না পড়ে, তাই। আর অবশ্য যাতে পায়, তাই। কি ঘটেছে সংক্ষেপে লিখল। আর লিখল, বাকি জীবন কেবল অভিশাপ দিয়ে যাও। সেটা আমার প্রাপ্য। জগৎ নতুন শ্বশুরবাড়িতে আছে। সেই ঠিকানা দিল।
চারদিন বাদে রত্নার জবাব এলো। খুব ছোট চিঠি। তোমার বাবার শরীরের অবস্থা এখন আশংকাজনক। সময় হয়ে আসছে বোঝা যায়। তাকে কিছু বলার দরকার নেই। এ শনিবারও যদি দেশে না আস তাহলে পরের শনিবার পর্যন্ত টিকবেন কিনা বলা যায় না। এক সপ্তাহ না আসাতে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
জগৎ অফিসের চাকরি রিজাইন করেছে। সে করেনি, সুমিত্রা করিয়েছে। তবু শনিবার পর্যন্তই অপেক্ষা করল। শনিবার আরো অনেক দূরে হলে যেন ভালো হত।
বাবার অবস্থার কথা সুমিত্রাকে জানিয়ে শনিবার দেশে গেল। বাবা তার হাত দুটো ধরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, আমার এই অবস্থা আর তুই পনের দিন পরে। এলি! আমি যে তোকে দেখার জন্যেই প্রাণটা ধরে বসে আছি।
সত্যিই তাই। তিনদিনের মধ্যে ছেলের কলকাতায় ফেরা হলনা। তিনি চোখ বুজলেন। দাহ কাজ শেষ করে জগৎ সেদিনই কলকাতায় এলো। টাকা নিয়ে আবার সেদিনই রাতে ফিরল। এ কদিনের মধ্যে রত্নার সঙ্গে তার একটিও কথা হয়নি। সে শ্বশুরের ঘরে শ্বশুরের কাছেই থেকেছে। এরই মধ্যে দু-বেলার রান্না সারতে হয়েছে। জগৎ-এর খাবার তার ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে। তার খাওয়ার সময়েও সামনে থাকেনি।
রাতে ফিরতে খুব ঠাণ্ডা মুখে রত্না সামনে এলো। বলল, গ্রামের লোককে জানিয়ে দিতে হবে ব্রাবার কাজ কলকাতার কালীঘাটে হবে।
মনের অবস্থা যা-ই হোক জগৎ অবাকই হল একটু।–কালীঘাটে হবে?
–হ্যাঁ। তা না হলে আমার কাজ করতে অসুবিধে।
–তুমি কাজ করবে!
রত্না ঠাণ্ডা দু-চোখ তার মুখের উপর তুলল।আমি ছাড়া আর কে করবে?
ঘর ছেড়ে চলে গেল। কথাটা জগৎ-এর মাথায় ঢুকল। সে এখন ক্রিশ্চিয়ান। শাস্ত্রমতে বাবার কাজ করার অধিকার এই জন্যেই নেই। কিন্তু ছেলে থাকতে এখানে বসে পুত্রবধূ শ্বশুরের কাজ করছে দেখলে সকলে হাঁ হয়ে যাবে।
রাতে রান্নার প্রশ্ন নেই। কারণ ফলাহার জলাহার বিধি। রত্না দুধ আর ফল তার ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে গেল। তার দিকে তাকালো না বা একটি কথাও বলল না। জগৎ মিত্রর বুকের ভিতরটা একটা যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল। একবার ইচ্ছে হল রত্নাকে জোর করে ধরে আনে, বলে কি অবস্থায় পড়ে তাকে এ কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা আরো হাস্যকর।
পরদিন সকালে বাবার ঘরে এসে রত্নাকে বলল, ব্যবস্থাপত্রর জন্য আমি তাহলে। কলকাতায় চলে যাই?
রত্না জবাব দিল, হ্যাঁ। না গেলে আমার এখানে তিন রাত থাকতে অসুবিধে হবে–যিনি চলে গেছেন তার জন্যে এখানে তিন রাত থাকা দরকার। ব্যবস্থা করার কিছু নেই, আমার বাবা কলকাতা চলে গেছেন, সেখানে মামারা ব্যবস্থা করবেন।
কলকাতায় রত্নার মামার বাড়ি। বড় অবস্থা তাদের। জগৎ এ-ও বুঝল তার। শ্বশুরকে মেয়ে সব জানিয়েছে। এমন অসহায় অবস্থা বলেই জগৎ হঠাৎ রেগে গেল। -আমার বাবার শ্রাদ্ধের খরচ যোগাবেন তোমার বাবা আর মামারা?
ঠাণ্ডা দু-চোখ এবারে তার মুখের ওপর উঠে এলো। বলল, যা খরচ হবে বাবা তার হিসেব রাখবেন। কাজের পর তাকে দিলে সে টাকা যেন তিনি নেন আমি বলে দেব।
তেমনি রাগত মুখেই জগৎ আবার বলল, আমিই যখন তোমার আর কেউ না, আমার বাবার জন্য তুমি এত কষ্ট করতে যাবে কেন?
-সেটা আমার রুচি। আপত্তি থাকলে টাকা দেবার দরকার নেই।
এর আধঘণ্টার মধ্যে জগৎ কলকাতায় রওনা হল।
বাবার কাজের দিন কালীঘাটে এলো। কাজের ব্যবস্থা, দান-সামগ্রী সবই পরিমিত বটে, কিন্তু পরিচ্ছন্ন সুন্দর। জগৎ অদূরে দাঁড়িয়ে সমস্তক্ষণ কাজ দেখল। কেউ তার সঙ্গে একটি কথাও বলল না। শ্বশুর বা মামাশ্বশুর বা রত্না তার দিকে একবার তাকালোও না। পুরোহিত মন্ত্র পড়িয়ে গেলেন, অনুষ্ঠান পালন করালেন। রত্না মন্ত্র পড়ছে, যা বলা হচ্ছে, তাই করছে। তার পরনে টকটকে লালপেড়ে গরদ। মাথার খোলা চুল। পিঠ বেয়ে কোমর ছুঁয়ে আছে। কপালে সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর। জগৎ মিত্রর ভিতর থেকে একটা অব্যক্ত কান্না গুমরে উঠতে লাগল। দুচোখ খরখরে শুকনো।
কাজ শেষ হল। জগৎ রত্নার এক মামাতো ভাইকে বলল, কত খরচ হল একটু জেনে দিতে হবে।
দু মিনিটের মধ্যে সে ফিরে এসে দু পাতার একটা হিসেব তার হাতে দিল। খবচের শুধু মোট অঙ্কটা দেখে নিয়ে জগৎ সে-টাকা রত্নার মামাতো ভাইয়ের হাতে দিয়ে চুপচাপ চলে গেল।
দেশে এলো একমাস বাদে। রত্নার ভরণপোষণের দায়িত্ব যখন আইনত আর ন্যায়ত তার, একটা ফয়সালা করতেই হবে। সেজন্যেই আসা।
বাড়ি তালা বন্ধ। তাই হবে ভেবেছিল। শ্বশুরবাড়িতে এলো। শ্বশুর বাইরেই বসেছিলেন। ভিতরে ডাকলেন না বা বসতে বললেন না। গলা দিয়ে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন। –রত্না এখানে থাকে না।
দ্বিধা কাটিয়ে জগৎ জিগ্যেস করল, কোথায়..?
–জানার দরকার নেই।
জগৎ চলে এলো। অপমানে মুখ কালি। তার কেন আসা শ্বশুরকে সেটা শুনিয়ে আসতে পারত। তা-ও পারল না।
কলকাতা। জগৎ মিত্রর ষষ্ঠ অনুভূতি প্রখরই বলতে হবে। তার ধারণা, রত্না কলকাতায়। মামাবাড়িতে থেকে কলেজে পড়ছে। ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভাবনা থাকলে সেটাই স্বাভাবিক।