বাধা তার ঘরের অতি সাধারণ বিবাহিতা স্ত্রীটি। প্রথম অধ্যায়ে সে স্বামীর গরবে গরবিনী, অর্থাগমের প্রাচুর্যে সুহাসিনী। কিন্তু ক্রমে কাটার মতো একটা সংশয় বিঁধতে শুরু করেছে তার হৃদয় নামে কোমল বস্তুটির ওপর। আর তারপর যত দিন যাচ্ছে, সেই কাটা ছুরির ফলা হয়ে তার বুকের তলায় কাটাছেঁড়া করে চলেছে। স্বামীর লোভের ব্যাধি এতদূর গড়িয়েছে যে তাকে ফেরানোর সকল চেষ্টা ব্যর্থ। শেষে কোনো রোগিনীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আদালতে এক চাঞ্চল্যকর বিচারের অনুষ্ঠান। আসামী ওই ডাক্তার, আর প্রমাণসহ তার বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী তার স্ত্রী। দুনিয়ার একটি মাত্র ভালবাসার মানুষকে কঠিন সঙ্কল্পে শুচিশুদ্ধ করে ভোলার সাদা নজির রেখে গেল যে রমণী, আর সে অতি সাধারণ নয়, বড় বিচিত্র।
বলা বাহুল্য, আজকের দিনের লোভ পাপ ব্যাভিচার আর হানাহানির ঝড়ো হাওয়ায় এই গোছের এক ভাবপ্রবণ নাটকের সাফল্যের সবটুকু অভিনয়। কিন্তু মিথ্যে বলব, আত্মস্থ অভিনয়গুণে ওই রমণী দর্শকের চোখে ক্রমশ বিচিত্র রূপিণীই হয়ে উঠেছিল। তার প্রথম দিকের হাসিখুশি আর স্বামীর প্রতি সরল বিশ্বাস আর নির্ভরতা পুরুষ মাত্রেরই লোভের বস্তু যেন। তার রোষ তার ঘৃণা তার বিদ্বেষ তার নীরব যন্ত্রণাও শুদ্ধ অনুরাগ আর অব্যক্ত আকুতির তাপে মহিমান্বিত। এই মহিমার সামনে দাঁড়িয়ে পুরুষ মুগ্ধ হতে আর অবনত হতে বাধ্য।
.
আমি জানি, রঙ্গালয়ের এত শত দর্শকের মধ্যে আমার মতো নির্মম-জ্বর সমালোচনার চক্ষু নিয়ে আর একজনও বসে নেই। অথচ আশ্চর্য, আমিও যেন অবিশ্বাস থেকে এক লোভনীয় বিশ্বাসের দুনিয়ার দিকে পা বাড়িয়েছি। ওই রমণী যেন অভিনেত্রী নয়, যা ঘটছে তার সবকিছুর সঙ্গে বুঝি তার জীবনের যোগ। সেই জীবন যত ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তার চোখে মুখে আচারে আচরণে রমণীসত্তার ওই দুর্লভ দুর্লঙ্ মহিমা ততো বেশি এঁটে বসছে।… পুরুষকে ফিরতে হবে, সে না ফিরে যাবে কোথায়?
তিন অঙ্কের নাটক। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে দর্শকের বিপুল করতালি আর স্বতস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের ডালি নিয়ে দৃপ্ত সংহত নায়িকা মুগ্ধ দর্শকের চোখের আড়ালে চলে গেছে। ড্রপ সীন নেমেছে। সমস্ত আলো জ্বলে উঠছে।
আমার ভিতরে ভিতরে সেই থেকে কী একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। নিভৃতের কোন পাতাল থেকে একটা আক্রোশ ঠেলে উঠে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়েছিল। উঠলাম। বাইরে এলাম। তারপর অনেকটা নিজের অগোচরে যেন উইংস-এর দরজা দিয়ে পিছনের অন্দরে চলে এলাম। ভিতর থেকে শব্দশূন্য অব্যক্ত গর্জন উঠছে একটা। –এই যদি সত্যি হয়, পুরুষ যদি কল্পনায়ও এ-ভাবে ফিরতে পারে তাহলে যে-ঘরে। আমি ছিলাম, সেই ঘর এভাবে ভেঙে গেল কেন? পুরুষ ফেরানোর এই সঙ্কল্প সেদিন তোমার কোথায় ছিল? সাত বছরের একটা ছেলেকে হত্যা করে আজ তুমি রমণীর মহিমা দেখাতে এসেছ? তোমার এই মহিমা দেখে যারা ভুলছে ভুলুক, আমি তোমাকে ক্ষমা করব না, তোমার ক্ষমা নেই
পিছনে পাশাপাশি দুটো সাজঘর। একটা পুরুষদের, অপরটা মেয়েদের।
আসুন আসুন, মা-কে খুঁজছেন বুঝি? মেয়েদের ঘরের দরজার কাছ থেকে আপ্যায়ন জানালো যশোদা। ফিরে দাঁড়িয়ে ডাকল, মা, কে এসেছে দেখুন!
যশোদা তিন-চার বছর যাবৎ চেনে আমাকে। দেখলে যতটা সম্ভব মুখে খুশির ভাব ফোঁটায়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটু যেন বিব্রত বোধ করে। ডাকসাইটে অভিনেত্রীর স্নেহ কেড়েছে, তাকে ভালবাসে, বলে ডাকে। তার কাছেই থাকে। আমাকে দেখলেই বোধহয় মনে হয়, ও আমার জায়গা জুড়ে বসে আছে। বেশ মিষ্টি মেয়ে, মিষ্টি কথা-বার্তা। মিষ্টি মিষ্টি হাবভাব। কোথা থেকে কিভাবে এসে অতবড় অভিনেত্রীর বুকের কাছে একটু জায়গা করে নিয়েছে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। শিল্পী হবার সাধ যত ছিল সাধ্য তততা ছিল না। রূপ সাধারণ, প্রতিভাও তাই। ছবিতে বা মঞ্চে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সারির শিল্পীর কাজ জোটে তার। নিজেই বলে, মায়ের আশ্রয় না পেলে কোথায় ভেসে যেতাম ঠিক নেই, কেউ একটা ঝিয়ের রোল দিয়েও জিগ্যেস করত না। এখন যেটুকু শিখেছি তাও মায়ের দয়াতেই।
বড় শিল্পীর সুপারিশে অনেকের ভাগ্য ফেরে, সেটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু যশোদার মাতৃভক্তি দেখলে আমার কেমন হাসি পায়। ওর এই ভক্তিটা অন্ধ অকৃত্রিম মনে হয় বলেই হয়তো। ওই মা ওর কাছে শুধু গুরু নয়, দেবীও।
কিন্তু সেদিন আমার হাসি পাচ্ছিল না।
ওর ডাক শুনে শিথিল চরণে দরজার কাছে এগিয়ে এলো যে রমণী, সে অনন্যা শিল্পী বিপাশা দেবী, কি চক্রের অন্তঃপুরসীমন্তিনী, কি আর কেউ-সেটুকুই যেন আগে যাচাইয়ের বিষয় আমার।
কি রে, তুই এসেছিস! নাটক দেখছিস নাকি?
এতক্ষণের নিভৃতের সেই গর্জনের অনুভূতিটা আমার দুটো হাতের মধ্যে এসে আকুলি-বিকুলি করতে লাগল হঠাৎ।
এই হাত দুটো যা চাইছে এখন তাই যদি হয় রমণীর ওই নরম গলার ওপর যদি আস্তে আস্তে উঠে আসে, ধীর অব্যর্থ অমোঘ নিষ্পেষণে, ওই আত্মস্থ নরম দেহের প্রাণটুকু যদি এই দুটো হাতের মুঠোয় টেনে বার করে নিয়ে আসে–তাহলে কে যাবে? শিল্পী বিপাশা দেবী, না চক্রের অন্তঃপুরসীমন্তিনী, না কি আর কেউ?
মাথা নেড়েছিলাম। নাটক দেখছি।
নিজে না আসিস, একটা ফোন করেও তো জানালে পারতিস, দেখতে আসবি, আমি ব্যবস্থা করে রাখতুম।… কেমন লাগছে?