সুমিত্রার মা জিজ্ঞেস করলেন, দেশে কে আছে তোমার?
–অসুস্থ বাবা। আর কে আছে সেখানে সেটা যে বলা হল না জগৎ মিত্রর। ও-বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে মনে হয়েছে।
রবিবার বাদ দিয়ে পরের সোমবার জগৎ এখানে আসবে, গাইবে, গল্প করবে, খাবে কথা দিয়ে তবে নিষ্কৃতি। একেবারে নিষ্কৃতি, ঠিক বলা যায় না। কারণ, সুমিত্রাও তার সঙ্গে এসে গাড়িতে উঠল। মেসে পৌঁছে দিয়ে ফিরবে। তার বাবা-মা আদরের মেয়ের স্বাধীনতায় এতটুকুও কটাক্ষ পর্যন্ত করেন না লক্ষ্য কুরল।
জগৎ-এর ভালোও লাগছে, আবার বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। দুজনের মাঝখানে। চার-ছ আঙ্গুলও ফারাক নেই, মেয়েটার সেদিকে হুশ নেই। মাঝে মাঝে কাঁধে কাধ ঠেকছে, ওর তপ্ত নিঃশ্বাস মুখে লাগছে। খুশি মেজাজে সুমিত্রা বকেই চলেছে। এ রকম এক অদ্ভুত যোগাযোগের ফলে ওর নাকি দারুণ মজা লাগছে। আজকের গানগুলোর প্রশংসা করল, এমনি একখানা রেকর্ড আর ছবির হট গানের রেকর্ড তার কালেকশানে আছে জানালো। আবার কবে নতুন রেকর্ড বেরুবে খোঁজ নিল। ফাঁকে ফাঁকে নিজের কথাও ঘুরিয়ে বলল। বি-এ পাশ করে এবারে এম-এতে ভর্তি হয়েছিল–আর পড়তে ভালো লাগল না বলে ছেড়ে দিল। গান তার দারুণ ভাল লাগে–ওরও ইচ্ছে করে বড় বড় শিল্পীর মতো গাইতে। একজন ওস্তাদ রাখা হয়েছিল, কিন্তু তিন মাস ধরে সে সা রে গা মা পা ধা নি নিয়ে ওকে এমন নাকানি-চোপানি খাওয়াতে লাগল যে, সুমিত্রা তাকে বিদায় করে বাঁচল। আর শেষে জিজ্ঞেস করল, আপনি সেদিন মিছিলে দাঁড়িয়েছিলেন কেন–চাকরি করেন নাকি?
এত বড়লোকের মেয়ের কাছে সামান্য চাকরির কথা বলতেও লজ্জা। জবাব দিল, এখনো করছি, আর বেশিদিন বোধহয় দরকার হবে না।
–তা তো হবেই না, এরই মধ্যেই যা নামখানা করে ফেলেছেন। জানেন, আপনার বন্ধুর বউ প্রমীলার সঙ্গে আমার এমন কিছু খাতির নেই–ও মনে মনে আমাকে হিংসা করে–কিন্তু আপনি আসছেন খবর পেয়ে ফোন করে নিজে সেধে নেমন্তন্ন নিলুম। তখন কি জানি আপনি–সেই মিছিলের আপনি।
গলির মধ্যে মেসবাড়ি। গাড়ি ঢোকে না। হারমোনিয়ামটা ড্রাইভারকে দিয়ে মেসে পাঠানো হল। দ্বিধা কাটিয়ে জগৎ বলল, মেসবাড়ি ১ দশা আপনাকে ডাকতে পারছি না–
–আর ডেকে কাজ নেই। কিন্তু আপনিই বা এ-রকম একটা জায়গায় থাকেন কেন? খুব পয়সা জমাচ্ছেন বুঝি?
-না… দেখেশুনে উঠে যাব ভাবছি কিন্তু সময় হয়ে ওঠে না।
তার অফিসের ফোন নম্বর লিখে নিয়ে আর সোমবার রাতের কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে সুমিত্রা চলে গেল। জগৎ মিত্রের মনে হল একঝলক বিদ্যুৎ সরে গেল।
পরদিন রত্নার চিঠি পেল। পারতে চিঠি লেখে না। কিন্তু মিছিলে এক মেয়ের কাছে হেনস্তার খবর জেনেই লিখেছে নিশ্চয়। তাই। ছোটর ওপর সুন্দর চিঠি।–তোমার চোখের ভাষায় নিশ্চয় কিছু ছিল। নইলে অচেনা অজানা ভদ্রলোকের মেয়ে ও-রকম করতে যাবে কেন? যাক, ওতেও যদি তোমার শিক্ষা না হয়ে থাকে তাহলে বাকি শিক্ষা আমি দেব। তবে একটু আশ্বাস দিতে পারি, সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকানো। আমার মতে ছেলেদের খুব বড় অপরাধ নয়। আর বে-আবরু না তাকালে মেয়েরা। সেটা অপছন্দও করে না। তুমি সেই মেয়ের দিকে কিভাবে তাকিয়েছিলে এখানে এসে তার মহড়া দিতে হবে–তবে বিচার করতে পারব। এরপর বাবার সম্পর্কে খুঁটিনাটি খবর। তার শরীরটা নাকি বেশ ভেঙেই পড়ছে।
শনিবারে দেশে যেতে পরের খবর বিস্তারিত শোনার পর রত্না হাঁ একেবারে। তারপর সে কি হাসি। হাসি আর থামতেই চায় না। শেষে বলল, বেচারি সুমিত্রা চৌধুরী –তোমার ঘরে যে বউ আছে তাকে সেটা বললেই না?
-বলার আর চান্স পেলাম কোথায়! সোমবারে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে বলব।
রত্না সাবধান করল, তাহলে খাওয়ার পরে বোলো, নইলে কপালে কি জুটবে কে জানে!
কিন্তু সোমবার নেমন্তন্ন খেতে এসে জগৎ মিত্রের আবারও দিশেহারা দশা। সুমিত্রা তার একগাদা বান্ধবীকে নেমন্তন্ন করেছে, ডজনখানেক বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছে, সেই সঙ্গে আর যাকে নেমন্তন্ন করেছে তাকে দেখে তো জগৎ-এর দস্তুরমতো রোমাঞ্চ। এক রেকর্ড কোম্পানীর হর্তা-কর্তা সেই ভদ্রলোক। এদিকে হারমোনিয়াম আর তবলার ব্যবস্থাও করে রেখেছিল। এদিনও গুণে গুণে দশখানা গান হল। রেকর্ড কোম্পানীর ভদ্রলোক প্রশংসা করতেই সুমিত্রা তাকে নিয়ে পড়ল।মাত্র দু-খানা রেকর্ড কেন ওঁর? শুধু মুখে প্রশংসা করলেই হবে? কবে রেকর্ড করবেন বলুন, আমি নিয়ে যাব।
ভদ্রলোক দিন তারিখ বলার পর রেহাই পেলেন। আর তার পরেও মাঝে মাঝে রেকর্ড করবেন কথা দিলেন।
খাওয়া-দাওয়া সারা হতে এই রাতেও সুমিত্রা তাকে নিজের গাড়িতে পৌঁছে দিতে এলো। আগের দিনের থেকেও বেশি ঘন হয়ে বসে ফিক করে হেসে বলল, কেমন–মিছিলে ওভাবে জব্দ করার পুরস্কার পেলেন তো? বছরে ক-খানা করে আপনার। রেকর্ড করাই এবারে দেখবেন।
জগৎ মিত্র জিজ্ঞেস করল, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনাদের কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক আবার কি উনি চ্যাটার্জি আর আমরা চৌধুরী ক্রিশ্চিয়ান। বাবার সঙ্গে অল্পস্বল্প খাতির ছিল, বাবা নিজে ইন্টারেস্ট নিয়ে ওঁর বাড়িটা খুব কম খরচে করে দেবার পর থেকে আমাদের বাড়ির সঙ্গেই এখন দারুণ খাতির। উনি নিজের ক্ষমতায় ডবল খরচ করেও অত বড় বাড়ি করতে পারতেন না। বাবা বিরাট কন্ট্রাক্টর জানেন তো?