এই সময় পাশের একটা গাড়ির দিকে দুচোখ আটকে গেল। পিছনের সীটে একটি মেয়ে বসে আছে, বছর একুশ হবে বয়েস। মেয়েটির চোখে বড়-সড় একটা সানগ্লাস। একটু লালচে চুল, বেশ ফর্সা। গাড়ি এভাবে আটকে যাওয়ার দরুন মুখে রাজ্যের বিরক্তি। জগৎ হাঁ করে তাকেই দেখতে লাগল। মেয়েটা তার পাশেই দুহাতের মধ্যে।
সেই মেয়েও দেখল তাকে। বার কয়েকই দেখল। দেখছে যে, সানগ্লাসের দরুন জগৎ সেটা বুঝতে পারল না। নইলে অমন বোকার মতো চেয়ে থাকত না।
মেয়েটা হঠাৎ একঝটকায় সানগ্লাসটা খুলে ফেলে মুখটা গাড়ির জানালা দিয়ে একটু বার করে, দুচোখ টান করে তার দিকে চেয়ে রইল। রাগত মুখের ভাবখানা, কত দেখবে দেখো, খুব ভালো করে দেখো! এই যাদের স্বভাব তারা আবার পথ আগলে দেশ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে!
জগৎ হঠাৎ এত ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল যে, মেয়েটা একটু বাদে ফিক করে হেসেই ফেলল। আর কথা নেই। জগৎ এদিক-ওদিক চেয়ে হঠাৎ লাইন থেকে সটকান। গাড়িটার পাশ দিয়ে পালানোর সময় মেয়েটা জোরেই হেসে উঠল। জগৎ-এর দুকান গরম। এদিকের ফুটপাথে উঠে ঘুরে তাকালো। মজা পেয়ে মেয়েটা এদিকের জানলায় সরে এলো। আর সোজা ওর দিকে চেয়েই হাসতে লাগল। জগৎ হনহন করে উল্টো দিকের রাস্তা ধরল।
মেয়েটার ওই হাসি আর ওই চাউনি ওর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। অন্যদিকে আত্মাভিমানও চাড়িয়ে উঠতে লাগল। আগামী দিনের কতবড় এক গায়ক ঐ মিছিলে। দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা যদি জানত, আক্কেল হত। মেসে ফিরে কল্পনায় আক্কেল হওয়ার। ছবিটা ধরতে চেষ্টা করল। করে প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ পেতে চেষ্টা করল। শেষে কলম নিয়ে বউকে চিঠি লিখতে বসল। সেটা সবে সোমবার, শনিবার পর্যন্ত ঘটনাটা পেটে চেপে রাখা কঠিন।
লিখে সেই দুপুরেই পোস্ট করে দিল।
তার ঠিক দুদিনের মধ্যে সত্যিই এক বিচিত্র যোগাযোগ। বালিগঞ্জের এক বড়লোক বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে নেমন্তন্ন খেতে গেছল। জগৎ মিত্র সেখানে মাননীয় অতিথি। তার সোলো গানের আসর হবে। বন্ধুর বায়না অন্তত দশখানা গাইতে হবে। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই গাড়িতে জগৎ তার হারমোনিয়াম নিয়েছে। তবলচি বন্ধুই জোগাড় করে রেখেছে। রেডিও আর্টিস্ট, কয়েকটা গান রেকর্ড হয়েছে, দু দুটো গান ছবিতে সুপারহীট–এমন ছোট আসরে দারুণ খাতির কদর হবে না কেন?
ছেলের থেকে মেয়ের ভিড়ই বেশি। তাদের মুখে মুখে বায়না এটা গান, ওটা গান। এক-একটা গান শেষ হলেই আবার বায়না। পাঁচখানা গান গাওয়ার পর ষষ্ঠ গান সবে শুরু করবে, সামনের মেয়ে পুরুষদের ঠেলে সরিয়ে যে মেয়েটি সামনে। এসে দাঁড়ালো তাকে দেখেই জগৎ-এর দুচক্ষু স্থির। মিছিলের রাস্তার সেই মোটরগাড়ির মেয়ে। কল্পনার প্রতিশোধ যে এমন বাস্তব হয়ে উঠতে পারে ভাবা যায় না।
মেয়েটি খুব সপ্রতিভ মুখে বলল, আমার নাম সুমিত্রা চৌধুরী–আমি আপনার এখানকার বন্ধুর স্ত্রীর বন্ধু। আচ্ছা, আপনাকে আমি খুব শীগগিরই কোথায় দেখেছি বলুন তো–দেখেছি ঠিক, কিন্তু মনে করতে পারছি না।
একটু দম নিয়ে জগৎ বলল, তরশুদিন দুপুরে রাস্তায় মিছিলে দেখেছিলেন… আপনি গাড়িতে বসেছিলেন, আমি আপনার পাশেই মিছিলে ছিলাম।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে এবারে আকাশ থেকেই পড়ল সুমিত্রা চৌধুরী।–এই খেয়েছে। আমি কার সঙ্গে কি ব্যবহার করেছি! তাই তো–আপনিই তো সেই–মিছিল ছেড়ে একেবারে ছুটেই পালিয়ে গেলেন। ছি ছি ছি, আচ্ছা আপনার গান শেষ হোক, তারপর ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
জগৎ আবার গান ধরল। এমন মনপ্রাণ ঢেলে আর কখনো গেয়েছে কিনা জানে না। একে একে আরো চারখানা গান। সকলে বাহবা বাহবা করে উঠল। খাওয়ার পরে সুমিত্রা চৌধুরী এসে ধরল তাকে।চলুন, আমার বাড়ি একবারটি যেতে হবে।–এই কাছেই।
জগৎ মিত্র বলল, আজ থাক, সঙ্গে হারমোনিয়াম আছে, গাড়ি না পেলে অসুবিধে হবে।
কানেই তুলল না। বলল, আপনার হারমোনিয়াম অলরেডি আমি আমার গাড়িতে তুলিয়েছি-ওটা আর তার মালিককে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। আসুন, ছাড়া পাচ্ছেন না–সেদিনের কাণ্ড আমি বাড়ি এসেই বাবা-মাকে বলেছিলাম আর হেসে গড়িয়েছিলাম–ছি ছি ছি! না জেনে–কি কাণ্ড করেছি বলুন তো!
জগৎ বলল, দোষ হয়তো আমারও কিছু ছিল।
অম্লানবদনে সুমিত্রা চৌধুরী বলল, তা তো ছিলই। মিছিলে দাঁড়িয়ে আপনি ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখছিলেন–আপনি জগৎ মিত্র সেই লোক জানলে তো উল্টে গর্ববোধ করতাম।
জগৎ আরো লজ্জা পেল। তাকে বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়ে এক হৈ-চৈ কাণ্ড বাধিয়ে দিল। কত বড়লোকের মেয়ে বাড়িতে ঢুকেই জগৎ টের পেয়েছে। তকতকে সাজানো-গোছানো সব ঘর, জেল্লা ঠিকরানো আসবাবপত্র। সুমিত্রার বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ হল। তারাও অমায়িক। আর একমাত্র মেয়ের প্রতি বাবা-মায়ের অন্ধ স্নেহেরও আঁচ পেল। চাকর দিয়ে হারমোনিয়াম নামিয়ে। জোর করে আবার তাকে বসিয়ে দিল–বাবা-মাকে দুটো গান অন্তত শোনাতে হবে।
জগৎ-এর মনে হল, এই মেয়েটার ইচ্ছেতেই যেন জগৎ চলছে। কোনো বাধা। মানার বা আপত্তি শোনার পাত্রী নয় সে। দুটো গানের পর বাবা-মায়ের সামনে সে কথা আদায় করতে চাইল, সামনের রবিবার সন্ধ্যায় এখানে আসবে এবং খাবে। কারণ আজ নেমন্তন্ন খেয়ে আসার পর আর খাওয়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। ফাঁপরে পড়ে জগৎ মিত্র বলল, রোববারে আমি কলকাতায় থাকি না, দেশে যেতে হয়।