পড়েছি।
–দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি পড়েছেন?
-তা-ও পড়েছি।
-কোনটা আগে পড়েছেন?
মোহিনী সরকার একটু আমতা-আমতা করার ফাঁকে বিভা সরকার জানান দিলেন, দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি পড়েই তো আমাকে জব্দ করার জন্য তাড়াতাড়ি ওই পূজাসংখ্যাটা নিয়ে বসেছিলেন।
দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি একজন রূঢ় অথচ নামী সমালোচকের সমালোচনার হেড-লাইন। একে একে তিনি এবারের নামী লেখকদের লেখা নিয়ে একটা নামকরা কাগজে আলোচনা করেছেন। প্রথমেই মহাদেব গাঙ্গুলির দ্বিতীয় বাসর নিয়ে পড়েছেন। আর বাস্তবশূন্যতার তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে হেড-লাইন দিয়েছেন, দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি!
নিজের গেলাসে আর একটা চুমুক দিয়ে মহাদেব গাঙ্গুলি বললেন, বেশ।.. পূজাসংখ্যায় কিছুটা তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখতে হয়, কি লিখেছি না লিখেছি মনেও থাকে না। নিজেকে ডিফেন্ড করতে হলে গল্পটা আগে ভালো করে মনে পড়া দরকার। দ্বিতীয় বাসরে কি আছে আপনি ছোটর ওপরে বলতে পারবেন?
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো করে মোহিনী সরকার জবাব দিলেন, নিশ্চয় পারব।
–বলুন তাহলে। আমার বক্তব্য পরে।
পরিবেশ জমে উঠেছে। মোহিনী সরকার মাঝে মাঝে গেলাসে চুমুক দিয়ে যা বললেন, সংক্ষেপে দ্বিতীয় বাসর-এর কাহিনী মোটামুটি তাই। এবং সেটা এইরকম।
–দুটি গ্রামের ছেলেমেয়েকে নিয়ে গল্প। ছেলেটি জগৎ মিত্র। কাছাকাছির শহরের কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে তিন বছর যাবৎ কলকাতার এক বে-সরকারী অফিসে চাকরি করছে। বয়েস চব্বিশ। চাকরি করলেও গান তার ধ্যানজ্ঞান। কলেজে পড়তে ছাত্রমহলে তার গানের সুনাম হয়েছিল। কলকাতার ছোট, মাঝারি, বড় আধুনিক গানের আসরেও ইদানীং তার ডাক পড়ছে। রেডিওয় চান্স পাচ্ছে। তার গাওয়া এক ছবির দুটো গান রীতিমতো হীট করেছে। জগৎ মিত্র আশা করছে, শীগগিরই আর তার চাকরি করতে হবে না। কারণ গানের রোজগার আশাতিরিক্ত বাড়ছে।
মেয়েটির নাম রত্না। একই গাঁয়ের মেয়ে। বসু ছিল, মিত্র হয়েছে। সে-ও ওই কাছাকাছি শহরের আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। চেনা-জানা ঘর, জগৎ মিত্রের অথর্ব বাবার আগে থাকতে মেয়েটার ওপর চোখ ছিল। ছেলে চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এই বিয়েতে প্রেমট্রেমের কোনো ব্যাপার নেই। মেয়েটাকে রূপসী না বললেও বেশ সুশ্রীই বলতে হবে। তার বয়েস উনিশ। সে গ্রামে। থেকে প্যারালিটিক শ্বশুরের পরিচর্যা করে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই চঞ্চল বউটিকে দারুণ ভালবাসেন। তার শাসন নেই বলেই রত্নার আচরণ গাঁয়ের বউয়ের মতো নয়-শ্বশুরের আদুরে মেয়ের মতো। শ্বশুরের সেবা-যত্ন করে, পুকুরে সাঁতার কাটে, ওর থেকে বয়সে ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে চোবায়, দুপুরে নিরিবিলি। পেয়ারা, কুল, আতা, জামরুল গাছে ওঠে, নয় তো এক মাইল দূরের বাপের বাড়িতে টহল দিয়ে আসে। প্রত্যেক শনিবারের বিকেলে জগৎ আসে, সোমবার খুব ভোরে চলে যায়। এই শনিবারটার জন্য রত্না যে উন্মুখ হয়ে থাকে জগৎকে তা বুঝতে দেয় না। দুষ্টুমি মাথায় চাপলে সে আসার পর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শ্বশুরকে নিয়ে বা রাঁধা-বাড়া নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে যে, জগৎ তাকে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পায় না। ফলে তার রাগ হবেই। সে অন্য পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কিন্তু রত্নার রাগ ভাঙানোর রীতিটাও আসুরিক। সুড়সুড়ি দেবে, কথা না বলে খুনসুড়ি করবে, তারপর একসময় জগৎকে জাপটে ধরে খাটেই গড়াগড়ি খাবে। জগৎ তখন ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারে না। তবু রাগ দেখায়। বলে, সামনের শনিবার আমি আসছি না–
রত্না বড় বড় চোখ করে বলে, তুমি হলে গিয়ে আমার জগৎ। না এলে তো অন্ধকার দেখব।
-অন্ধকার দেখবে। তাহলে এতক্ষণ কি হচ্ছিল?
রত্না হেসে গড়িয়ে জবাব দেয়, এতক্ষণ জগৎ-এর সঙ্গেই রসকরা হচ্ছিল।
এর পরে আর রাগের আয়ু কতক্ষণ? গুনগুন করে অন্তত চার-পাঁচখানা গান শোনাতে হয়। জোরে গাওয়ার উপায় নেই, বাবার ঘুম ভেঙে যাবে। কলকাতায় কবে কোথায়, কি গাইল সেই গল্প করে। মাসের রোজগারের বাইরে গানের কল্যাণে কত বাড়তি রোজগার হল বলে। আর, আরো কিছু রোজগার বাড়লে কলকাতায় বাসা ঠিক করে রত্নাকে আর বাবাকে নিয়ে যাবার কথাও বলে। রত্না সাগ্রহে শোনে, কিন্তু রুগ্ন শশুর যে গাঁয়ের বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবে না তাও জানে। আর এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে ওর নিজেরও দুখানা খুপরির মধ্যে গিয়ে উঠতে কেমন লাগে সে সন্দেহও আছে।
জগৎ-এর ইচ্ছা ছিল, বউ কলেজে পড়ক। ফার্স্ট ডিভিসনে ম্যাট্রিক পাশ করেছে, কলেজে পড়লেও খারাপ রেজাল্ট করবে না নিশ্চয়। কিন্তু শ্বশুরের দোহাই দিয়ে রত্ন সে-প্রসঙ্গ এড়াতে চেষ্টা করে। আসলে দিব্যি আনন্দে আছে, এর মধ্যে আবার পড়াশুনার ঝামেলার মধ্যে কে ঢোকে। জগৎ প্রাইভেটে আই. এ. পরীক্ষা দেবার জন্য তাকে তৈরী হতে বলে। রত্না তখন তাকে কাজের যে ফিরিস্তি দেয়, তাতে পড়াশুনা ছেড়ে কারো নিঃশ্বাস ফেলারও সময় হবার কথা নয়।
এই সুখের দিন হঠাৎ ফুরালো।
তার সূচনাও আকস্মিক। কলকাতার সমস্ত অফিসের কর্মচারীরা হঠাৎ একদিনের ধর্মঘটে নেমেছিল। তাদের মিছিলে জগৎকেও টেনে নামানো হয়েছিল। সেটা একচল্লিশ সাল। স্বাধীনতার দাবি বা ইংরেজ শাসনের কোন-না-কোন অন্যায় উপলক্ষে কলকাতায় তখনও মিছিল লেগেই ছিল। অভিযোগ অন্য কোন অফিসের একজন কর্মচারীকে ইংরেজের পুলিশ ঠেঙিয়ে মেরে ফেলেছে। তাই সমস্ত অফিসের কর্মচারীদের পরদিন অফিস বয়কটের ডাক। একে যুদ্ধের সময় সেটা। দু-পক্ষই মারমুখী। সরকার ট্রাম বাস গাড়ি চলাচল বন্ধ হতে দেয়নি। অন্যদিকে এই বিশাল মিছিলও পথ আগলে মনুমেন্টের দিকে এগোচ্ছে। ফলে রাস্তা জ্যাম। ট্রাম, বাস, মোটর, লরির লম্বা জট। এক জায়গায় মিছিলও দাঁড়িয়ে গেছে, ওগুলোও। জগৎ মিত্র কেটে পড়ার তাল খুঁজছিল। এক্ষুণি হয়তো পুলিশ এসে কাঁদানে বোমা ছুঁড়বে আর লাঠিপেটা করে মিছিল ভেঙে দিতে চাইবে।