বিভা সরকার প্রতিবাদ করলেন, কেন, তুমি পড়ো না?
মোহিনী সরকার জবাব দিলেন, পড়তে হয়। কারণ আলোচনা যখন হয় তখন আমি তোমাকে বিপাকে ফেলার মতো তবলচির কাজ করি। যেমন ধরো ওই পূজাসংখ্যাটায় ওঁর এবারের উপন্যাস দ্বিতীয় বাসর পড়ে আলোচনায় আমি তোমাকে যে-রকম কোণঠাসা করেছিলাম, যার ফলে তুমি একেবারে দাম্পত্য কলহের পর্যায়ে চলে গেছলে।
বিভা সরকার তক্ষুনি তাকে সামলাবার জন্য ব্যস্ত।থাক থাক, আমি ঠিক জানি তুমি সব ছেড়ে ওঁর এই লেখাটা নিয়েই পড়বে। লেখকের দিকে ফিরলেন, ওকালতি করে করে লোকের কেবল ছিদি বার করতেই শিখেছে-বুঝলেন?
-বুঝলাম। মহাদেববাবু গম্ভীর মুখে সায় দিলেন। কিন্তু আমাদের তো বিকেল থেকেই শাস্তি শুরু হবার কথা ছিল!
সাহিত্য-বিতর্ক আপাতত চাপা পড়ে গেল। চা আর পরিপাটি জলখাবার সহযোগে গল্পে-গল্পে শীতের ছোট বেলা পার। সন্ধ্যার একটু পরেই মোহিনী সরকার মহাদেববাবুর কানে কানে কি বলতে তিনি মুখখানা এমন করলেন যেন দুনিয়ার সব থেকে বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বলে উঠলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনার নিখুঁত আতিথেয়তা নিয়েই আমাকে কিছু লিখতে হবে–বিকেলে মধ্যপ্রদেশে যা চালান গেছে একটু ওষুধ না পড়লে রাতে ওর ওপর আবার চাপাব কি করে! আপনার বিবেচনার জয় হোক!
অন্য দুই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন ব্যাপারখানা। বিভা সরকার ঈষৎ বিব্রত মুখে সোমা গাঙ্গুলির দিকে তাকালেন একবার, তারপর সকোপে স্বামীর দিকে ফিরলেন। –আজ খুব সুবিধে পেয়ে গেছ, না?
মোহিনী সরকার বললেন, অতিথির দরকার কিনা খোঁজ নিলাম।… তুমি সঙ্গ দাও তো আমি ছোঁবও না। লেখকের দিকে ফিরলেন, গৃহিণী ডাক্তার হলে যে কি বিপদ মশাই আপনিও তো নিশ্চয় জানেন। ডাক্তার পরোয়ানা দিয়েছে, একটু-আধটু চলতে পারে, তাতে হার্টের ক্ষতি হবার কোনো আশংকা নেই। কিন্তু ওঁর বিশ্বাস সাংঘাতিক ক্ষতি হবার আশংকা, আমি ঘুষ দিয়ে ডাক্তারকে বশ করেছি। সঙ্গে আছে। অথচ নির্জলা রাত কাটছে। যাক, অতিথির দরকার যখন কি আর করা যাবে?
বিভা সরকার মাথা নেড়ে সোমাকে দেখালেন, ওঁর পারমিশন না হলে দেব না।
সোমা গাঙ্গুলি হেসে ফিরে বললেন, আপনার কি ধারণা, উনি আমার কথায় ওঠেন-বসেন?
বিভা হালকা জবাব দিলেন, আপনাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাই কিন্তু ভাবতাম। এখন দেব কিনা বলুন
-কটা দেবেন আগে কড়ার করে নিন।
বিভা সরকার হাসিমুখে মহাদেববাবুর দিকে তাকালেন। জবাবে তার সীরিয়াস মুখ।-খেলে উনি আমাকে দুটোর বেশি খেতে দেন না, আজ মনে হচ্ছে, তিনটেতে আপত্তি করবেন না।
বিভা সরকার বলে উঠলেন, ওঁর কিন্তু দুটোর বেশি কখখনো চলবে না। দুটোতেই দেখবেন কেমন স্পষ্ট বক্তা হয়ে উঠেছেন।
মহাদেববাবু সায় দিলেন, দুটোর বেশি চলার দরকার নেই তাহলে। প্রথমে ওঁকে একটা পুরো দেবেন, পরের দুটো হাফ হাফ।
বিভা সরকার উঠে হুইস্কির বোতল গেলাস আর জল এনে সামনে রাখলেন। বিলিতি জিনিস দেখে কর্তার দিকে চেয়ে মহাদেব্বাবু মন্তব্য করলেন, উকিল না হয়ে আপনার ওমর খৈয়াম হওয়া উচিত ছিল–ঘাটশিলায় বিলিতি জিনিস! স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, ও-গো, তুমি কি তিনটাকে চার করতে পারমিশান দেবে?
সোমা গাঙ্গুলি বললেন, আমার তিনেই আপত্তি।
–থাক থাক, তাহলে আর চা-রে কাজ নেই।
প্রথম দফা শুরু হতে নিজের গেলাসে বারকয়েক ছোট ছোট চুমুক দিয়ে মহাদেববাবু একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীর কথাই সমর্থন করলেন যেন। সীরিয়াস মুখ করে বললেন, বেশি না খাওয়াই ভালো।… একবার এক ভদ্রলোক বার থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে হাঁ। ড্রাইভ করবেন কি, তার স্টিয়ারিং, ব্রেক, অ্যাকসেলারেটর, ক্লাচ, ড্যাশবোর্ড–সব কিছু চুরি হয়ে গেছে। তক্ষুণি নেমে ছুটে গিয়ে তিনি ওই বার থেকেই পুলিশে ফোন করলেন। এমন তাজ্জব চুরির কথা শুনে পুলিশও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছুটে এলো। এসে দেখে স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে ভদ্রলোক বিমর্ষ মুখে বসে আছে। তারা উঁকি দিয়ে দেখল, কিছুই চুরি যায় নি। সবই ঠিক আছে। তখন তারা রেগে আগুন। ভদ্রলোক তখন বললেন, আমার সত্যি একটু ভুল হয়ে গেছে, তখন আমি ভুল করে পিছনের সীটে উঠে বসেছিলাম…।
সকলকে ছাড়িয়ে মোহিনী সরকার হা-হা শব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, আপনি তাহলে সর্বদা অত সীরিয়াস গল্প লেখেন কেন মশাই–হাসির গল্প লিখলে তো এর থেকে ঢের বেশি ভালো করতেন।
শুনেই মহাদেববাবু দস্তুরমতো গম্ভীর। একচুমুকে গ্লাসের বাকিটুকু শেষ করলেন। বিভা সরকারের দিকে তাকাতে তিনি উঠে দ্বিতীয় দফা তার গেলাস সাজিয়ে দিলেন। দেখাদেখি মোহিনী সরকারও চটপট তার গেলাস শেষ করে ওটা সামনে এগিয়ে দিলেন। বিভা সরকার তাকে মেপে অর্ধেকই দিলেন।
নিজের গেলাসটা তুলে নিয়ে মহাদেব গাঙ্গুলি আগের কথার জের টেনে মোহিনী সরকারকে জিজ্ঞেস করলেন, সীরিয়াস গল্প বলতে একটা নমুনা দিন।… দ্বিতীয় বাসর?
দ্বিতীয় গেলাস হাতে নেবার পর মোহিনী সরকারেরও ভিতর চাঙ্গা একটু। জবাব দিলেন, তা তো বটেই, ওটা আপনার সীরিয়াস উপন্যাসের সব থেকে অসার নমুনা–
বিভা সরকার বলে উঠলেন, তখনই বলেছিলাম এসব খেলে–
একটা হাত তুলে মহাদেব গাঙ্গুলি তাকে থামিয়ে দিলেন। গেলাসে একবার চমক দিয়ে ওটা সামনে রাখলেন। পলকা গম্ভীর চাউনি মোহিনী সরকারের মুখের ওপর। –দ্বিতীয় বাসর আপনি মন দিয়ে পড়েছেন?