–একেবারে খাঁটি ধরেছেন ম্যাডাম। আদি এবং অকৃত্রিম। স্ত্রীর লাল মুখের দিকে চেয়ে এবারে গম্ভীর আবার।–তাহলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়–প্রজাপতির এমন অসম নির্বন্ধ ঘটে কি করে। অতিথি দুজনকে সচকিত করে স্ত্রীকে হঠাৎ রুক্ষ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন তিনি, কতদিন বলেছি বয়েসের সার্টিফিকেটটা গলায় ঝুলিয়ে নাও-লোকের কাছে আমাকে এমন অপ্রস্তুত করার মানে কি?
বকুনির শেষ শুনে সরকার-দম্পতি আরও মজাদার বিস্ময়ের আঁচ পেলেন। সোমার লালচে মুখে হাসি চুয়ে পড়ছে। বললেন, নিজে অসময়ে সাত বুড়োর এক বুড়ো সেজে বসে আছ লজ্জাও করে না।
অন্য দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। খোকা গাঙ্গুলির মুখে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের ফাঁকে টিপটিপ হাসি। বললেন, এবারে তাহলে উপসংহারে আসা যাক। যদিও মেয়েদের বয়েস নিয়ে আলোচনা এটিকেটের বাইরে, তবু এই জমাটি পরিবেশের খাতিরে আমরা অকপট হতে পারি। বিশেষ করে যা নিয়ে এত কাণ্ড–দুচোখ মোহিনী সরকারের দিকে।-এবার আপনি তাহলে আমার মিসেসের বয়েসটা অনুমান করুন।
মোহিনী সরকার বোকা নন আদৌ। অনুমানের বেশ ওপরেই উঠলেন–পঞ্চাশ একান্ন…
হাসিমুখে সোমা গাঙ্গুলি ঘোষণা করলেন, আটান্ন।
-কক্ষনো না। প্রতিবাদ বিভা সরকারের। তার থেকেও মহিলা এক বছরের বড় এ বিশ্বাস করেন কি করে?
সোমা গাঙ্গুলি তেমনি হেসেই বললেন, তা হলে কলকাতায় ফিরে একদিন বাড়িতে আসুন, এজ সার্টিফিকেট দেখাব।
মোহিনী সরকার বলে উঠলেন, তাহলে কংগ্রাচুলেশন–অনেক কংগ্রাচুলেশন সোমা দেবী। এভাবে বয়সের চোখে ধূলো দেওয়াটা আমি দস্তুরমতো ক্রেডিট মনে করি।
ঘরের লোককে দেখিয়ে এবারে টিপ্পনীর সুরে সোমা গাঙ্গুলি বললেন, তাহলে ওঁকেও একটু কংগ্র্যাচুলেট করুন, আমার থেকে উনিও বয়েসের চোখে কম ধুলো দেননি–উনি সবে তেষট্টি এ কেউ বিশ্বাস করবেন, আমার থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড়।
অর্থাৎ মোহিনী সরকারের সমবয়সী। অন্য দুজনকে এবারেও একটু হকচকিয়ে যেতে দেখা গেল। খোকা গাঙ্গুলি বললেন, বিশ্বাস করবেন না। আপনার বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার রসটুকুই মাটি তাহলে।
-থামো। অন্যদের দিকে ফিরলেন সোমা গাঙ্গুলি।–এই জন্যেই আমাকে বার বার থামিয়ে দিচ্ছিলেন, বুঝলেন?… কমাস আগে ওঁর একটা অপারেশন হয়ে গেল, প্রোসট্রেট অপারেশন–সঙ্গে আরো সতের ব্যাপার–অপারেশনের পরেই তার ওপর। নিউমোনিয়া–যমে-মানুষে এমন টানাটানি আমি আর দেখিনি। তারপরেই মাথার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেল আর শরীরের এই হাল। দেখলে কেউ ভাবতেও পারবে না কি চেহারা কি হয়ে গেল।
খোকা গাঙ্গুলি গম্ভীর।–অর্থাৎ তখন ওঁর মতে আমি রূপবান পুরুষ ছিলাম।
মোহিনী সরকার আর বিভা সরকারের সত্যি ভারি ভালো লাগছিল। বিভা বললেন, আপনি যা-ই বলুন, অনেক ঠকেছি আমরা, আর আপনার কথার ফাঁদে পড়তে রাজি নই।
খোকা গাঙ্গুলি স্ত্রীকে বললেন, এবারে শুধু ওঁদেরই তাহলে আর এক পেয়ালা করে চা হোক।
মোহিনী সরকার তাড়াতাড়ি বাধা দিলেন, আর চা না, আমারও বেশি চায়ে একটু অসুবিধে আছে–গল্প করতে খুব ভালো লাগছে… আপনাদের সময় নিচ্ছি না তো?
দয়া করে সময় দিচ্ছেন, খোকা গাঙ্গুলির বিনীত জবাব, একটা বিকেল সন্ধ্যা ভালো কাটছে।
ভালো বিভারও খুব লাগছে। গলা একটু খাটো করে সোমাকে বললেন, অসুস্থ। মানুষকে একলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন, আপনার ছেলেপুলে…?
খোকা গাঙ্গুলি বলে উঠলেন, সে কথা তুলে আর লজ্জা দেবেন না, একটা দুটো নয়, একেবারে পাঁচটি। প্রথমে দুই ছেলে পরে তিন মেয়ে। গেলবারে ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে যেতে এখন আমাদের নির্ঝঞ্ঝাট হনিমুন।
যিনি বলছেন, তারই শুধু সিরিয়াস মুখ। অন্য সকলের হাসির ফাঁকে বিভা সরকার। পাঁচ ছেলেমেয়ের মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর আর একবার চোখ না বুলিয়ে পারলেন না। সোমা গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারাও তো দুজনেই এসেছেন দেখছি… আপনার?
-একটি ছেলে। ব্যারিস্টার। উনি প্র্যাকটিস কমিয়ে দিতে ওর ওপর চাপ বেশি–বেড়াবার সময়-টময় হয় না।
খোকা গাঙ্গুলি গম্ভীর মন্তব্য করলেন, ইন্দিরা গান্ধীর প্রাইজ দেওয়া উচিত আপনাদের–ছোট পরিবার সুখী পরিবার।
তেমনি নকল গাম্ভীর্যে মোহিনী সরকার বললেন, আপনাদের দেখে অসুখী যারা বলবে তাদের জরিমানা হওয়া উচিত। একটু কৌতূহল হচ্ছে, আপনার পেশাটি জানতে পারি?
খোকা গাঙ্গুলি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ব্যবসা।
-ব্যবসা বলতে?
–মিথ্যেকথার ব্যবসা। যত মিথ্যে বলি লোকে ততো খুশি আর ব্যবসাও ততো জমজমাট।
মোহিনী সরকার বিভা সরকার দুজনেই চেয়ে আছেন। সোমা অল্প অল্প হাসছেন। খোকা গাঙ্গুলি বললেন, বুঝলেন না তো? তাহলে শুনুন
নিজের ইজি-চেয়ারেই জমিয়ে বসলেন একটু। তেমনি গম্ভীর। পুরনো দিনের কথা মনে করার মতো করে বলে গেলেন, সে অনেক কাল আগের কথা, বিলেত থেকে এক জাহাজ মিথ্যেকথা চালান এসেছিল আউট্রাম ঘাটে। আমার তখন বেকার দশা। শুনে পড়িমরি করে ছুটলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি সর্বনাশ কাণ্ড। আগেভাগে টের পেয়ে বাঘা-বাঘা ব্যবসায়ীরা এসে সব কিনে নিয়ে গেছে। আমার মনে দুঃখ শুধু হল না, ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে লাগলাম। রাগে শোকে ওই গঙ্গাতেই প্রাণ বিসর্জন দেব ঠিক করে ফেললাম। বেগতিক দেখে মা গঙ্গা উঠলেন। বললেন, বাছা আত্মঘাতী হয়ে কাজ নেই, এখন থেকে মিথ্যাই তোর স্বচ্ছন্দ জীবিকার অবলম্বন হবে। ব্যস, আর কি, তারপর থেকে ওই মিথ্যের নৌকোতেই ভেসে চলেছি।