–দুই। আমি স্বীকারই করলাম, আপনাদের আমাদের সেই ওঁরা বলা ঠিক হয়নি।–বলা উচিত ছিল, বাইরে দেখা হয়ে গেলে আমরা যাঁদের সেই ওঁরা। তাই শুনেও আপনি বিলক্ষণ অবাক। অথচ বাইরে দেখা হয়ে গেলেই আপনারা যে আমাদের বেশ খুঁটিয়ে দেখেন, একজনের চোখে না পড়লে আর একজনকে খোঁচা দিয়ে বা ইশারায় আমাদের দেখান, আর আমাদের নিয়ে আলোচনা করেন–এসব আমার থেকে আপনারাই ভালো জানেন। এবারে আমার জবাবটা বুঝতে আর বোধহয় খুব অসুবিধে হচ্ছে না।
–তিন। সোমা আমার স্ত্রী শুনেই যেভাবে আপনি আপনার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, আমার ধারণা, শুধু বাজী জিতলেই অমন করে তাকানো যায়। কিন্তু আমি জেতা হারার কথা বলতে আপনি বুঝতেই পারলেন না।
বিভা সরকারের দু চোখ কপালে। লজ্জিত আর অপ্রস্তুত তো বটেই, অদ্ভুত ভালোও লাগছে। অথচ এই মানুষকে দেখে দূর থেকে স্বল্পভাষী মনে হত। অ্যাডভোকেট মোহিনী প্রকার চক্ষুলজ্জার ধার ধারেন না। এ যাবৎ অনেক মানুষ দেখেছেন, অনেক মানুষ চরিয়েছেন। সামান্য আলাপে এই লোকের বিচক্ষণ দৃষ্টিশক্তি আর অতি সহজে দুয়ে দুয়ে চারে পৌঁছানোর ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারলেন না। কোনো কথার প্রতিবাদ না করে অল্প অল্প হাসছিলেন তিনি। মুখের দিকে চেয়েছিলেন। হঠাৎ একটু উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এর আগে আপনাকে কি আমি কখনো কোথাও দেখেছি–অথবা আপনি আমাকে দেখেছেন?
ভালো করে মুখের ওপর একটু চোখ বুলিয়ে খোকাবাবু জবাব দিলেন, শাস্ত্রমতে দুজনেই দুজনকে দেখেছি।
–সেটা কি রকম? মোহিনী সরকার উৎসুক।
–শাস্ত্র বলে আমাদের প্রত্যেকটা যোগাযোগ পূর্বনির্দিষ্ট। আগের যোগাযোগ ভিন্ন কোনদিন কারো সঙ্গে পরের যোগাযোগ হয় না।
–আগের বলতে?
–আগের বলতে আগের জন্মের হতে পারে–তার আগেরও হতে পারে।
মোহিনী সরকার হাসলেন একটু।–না আমি এই জন্মের কথাই বলছি।
খোকাবাবু আবার তাকে দেখলেন। বললেন, মনে পড়ছে না।
বৃন্দাবন ট্রে-তে তিন পেয়ালা চা আর ডিশে বিস্কুট নিয়ে এলো। সোমা মোড়া ছেড়ে উঠে ভরতি পেয়ালা দুটো অভ্যাগতদের দিলেন আর কম চায়ের পেয়ালাটা তৃতীয় জনকে। বিভা সরকার জিজ্ঞেস করলেন, আপনারটা?
জবাব দেবার আগেই খোকা গাঙ্গুলি বলে উঠলেন, চলে না, চলে না–আমার আর এক দুর্ভাগ্য দেখুন, চায়ের সঙ্গী পর্যন্ত নেই। স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, তুমি আর এক পেয়ালা দুধ নিয়ে বোসো না, লজ্জা কি?
অন্যদিক থেকে কোপের প্রতিক্রিয়াটুকু অবিমিশ্র মিষ্টি লাগল মোহিনীবাবুর।
পরপর কয়েক চুমুকে নিজের পেয়ালা খালি করে এবং সেটা ইজিচেয়ারের পাশে রেখে খোকা গাঙ্গুলি নিশ্চিন্ত। একটু চুপ করে থেকে বললেন, এবারে আমাদের নিয়ে আপনাদের আসল যা কৌতূহল সেটা ব্যক্ত করে ফেলুন–একটুও লজ্জা করবেন না, আমি ও জিনিসটা অনেককাল বর্জন করেছি।
মোহিনী সরকার ঠোঁট-কাটা মানুষ, কিন্তু এ এমনি এক পরিস্থিতি যে অজ্ঞতার ভান করা ছাড়া উপায় নেই। বললেন, আর কি কৌতূহল?
-বলেন কি মশায়! ভদ্রলোক সত্যের অপলাপ দেখেই যেন আরো অবাক।–উনি আমার দ্বিতীয় পক্ষ না তৃতীয় পক্ষ নাকি চতুর্থ পক্ষ এই প্রশ্ন আপনাদের মনে নেই বলতে চান?
কর্তার থেকেও এবারে বিভা সরকার বেশি ফাঁপরে পড়লেন। সোমা গাঙ্গুলি এবারে ধমকেই উঠলেন, সেই থেকে তুমি যা করছ ওঁরা আর এদিক মাড়াবেন না।
মোহিনী সরকার বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনারা না চাইলেও আমরা নিশ্চয়। মাড়াবো, কারণ দোষী হয়েও এত আনন্দ কমই মেলে–লোকচরিত্র পাঠে উনি সিদ্ধ মানুষ এ অস্বীকার করতে পারছি না।
লজ্জা পেয়েও সোমা গাঙ্গুলি বলতে গেলেন, শুনুন এর মধ্যে ওঁর শরীরটা
খোকা গাঙ্গুলি একটা হাত তুলে বাধা দিলেন।–থামো, অপ্রাসঙ্গিক কথা আমি বরদাস্ত করি না জানোই তো। গম্ভীর।–কথা তোমাকে নিয়ে আমাকে নিয়ে নয়। এঁদের কৌতূহল এমন বৃদ্ধের অমন প্রায়-তরুণী ভার্যা কেন–বা কোন্ পক্ষের। মোহিনী সরকারের দিকে ফিরলেন।–ঠিক কি না?
মোহিনী সরকার ওকালতির মাথা খাটালেন। জবাব দিলেন, কৌতূহল যদি অস্বাভাবিক না হয়, অপরাধ স্বীকার করছি।
-খুব স্বাভাবিক। আমার মতো বৃদ্ধ কারো কৌতূহলের বিষয় নয়, ওঁর মতো মেয়েও কারো কৌতূহলের ব্যাপার নয়–দুই অসমের সাতপাকের অঘটনটুকুই কৌতূহলের স্বাভাবিক কারণ। এই কারণ না থাকলে আপনারা হয়তো আসতেনই না। স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, অতিথিদের বিমুখ না করে তুমিই বলে দাও কোন পক্ষ। এর মধ্যে লজ্জা পাবার বয়েস তো কারো নেই
সোমা গাঙ্গুলি প্রায় ধমকের সুরে বললেন, চালাকি করে কেবল কথা ঘোরাচ্ছ, তুমি আমাকে বলতে দিচ্ছ? বিভার দিকে ফিরলেন।–শুনুন, যা বলছিলাম, এই ছ মাস হল
-অবজেকশন মাই লর্ড অ্যান্ড লেডি-অবজেকশন। ইরেগুলার, ইর্যাশানাল অ্যান্ড ইমমেটিরিয়াল! মোহিনী সরকারের দিকে তাকিয়ে গলা খাটো করলেন খোকা গাঙ্গুলি। আপনাদের ভাষাটা ঠিক হল? তারপরেই আবার গলা চড়ালেন।-শুনুন, মেয়েরা–না। মানে আমার স্ত্রী অন্তত ঘোরা পথে চলেন, অর্থাৎ সোজা প্রশ্নের সোজা জবাব দিতে চান না, এ প্রমাণ তাহলে হয়েই গেল। ঠিক আছে, জবাব আমিই দিচ্ছি। পক্ষ বিচারে আপনাদের সব অনুমানই ভুল, এ সম্পর্কে একটা বিচারই খাটে–উনি চিরদিনই আমার বিপক্ষ।
হাসির মধ্যেই বিভা সরকার ঈষৎ বিস্ময়ে বলে উঠলেন, তার মানে উনি তাহলে প্রথম পক্ষ?