শোভা গাঙ্গুলির কান-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ওর রং ফর্সা। মায়ের তুলনায় ঢের বেশি সুশ্রী। ওর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করেই যেন বক্তব্যটা আর একটু নরম আর প্রাঞ্জল করে তুলতে চেষ্টা করেছিলাম। চটকদার অভিনেত্রী আর জাতশিল্পীর মধ্যে এও একটা বড় তফাৎ, বুঝলে? চটকদার অভিনেত্রীর চমক বেশি, প্রকাশ বেশি, আর জাতশিল্পী যেটুকু অনাবৃত করে, তার থেকে যেন ঢেকে রাখে বেশি–উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখতে লোভ জাগে।… তবে আমি যে তফাতের কথা বলছিলাম সেটা অন্য ব্যাপার। একটা ধরো ডালিয়া আর একটা রজনীগন্ধা।
যাক, কথা হচ্ছিল মায়ের মঞ্চাভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ আর তার লেটেষ্ট অবদান চক্র নাটক প্রসঙ্গে। আমি নিঃসংশয়-এ-ঝোঁক অর্থের তাগিদে নয়। টাকা তার প্রচুর আছে এবং আরো একশ বছর বেঁচে থাকলেও ওতে টান ধরবে না। তাছাড়া ইচ্ছে কবলে দিদি-বউদি অথবা কিশোর-কিশোরীর মায়ের বাছাই করা রোল-এ তাকে পাবার। নামী পরিচালক প্রযোজকরা এখনো হামেশাই তার কাছে ছোটাছুটি করে। তাদের ডাকে সাড়া দিলে এখনো মঞ্চের বিশ তিরিশ গুণ বেশি রোজগার হতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ পরিচালক প্রযোজককেই সে ফিরিয়ে দিয়ে থাকে।
এতটা উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে মঞ্চে নেমে আসার দুটো কারণ বোধহয়। প্রথম এর মাদকতা ভিন্ন স্বাদের। কবির কাজ অভিনেতা অভিনেত্রী আর কলাকুশলীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ক্যামেরার আর শব্দ-যোজনার কারসাজিতে অনেক ফাঁক আর ফাঁকি ভরাট করে দেওয়া যায়। কিন্তু মঞ্চে সোজাসুজি রসপিপাসু খদ্দেরের যাচাই বাছাইয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়ানো। এখানে কোনো ফাঁকির কারবার নেই। গোটাগুটি নগদ বিদায়ের ব্যাপার। সে বিরূপ হলে তার অভিব্যক্তি মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরে দেবে, খুশি হলে সরব উচ্ছ্বাসের অর্ঘ্যও পাঠাবে।
বিপাশা দেবীর মঞ্চপ্রীতির আড়ালে এটাই একমাত্র কারণ মনে হয় না। আসল। কারণ, বয়েস যেমনই গড়াক, নিজের কাছে নিজে সে এখনো দ্বিতীয় রহিতা। তাই প্রথম সারিতে এখনো স্থান চাই তার। সে বিশ্বাস করে এই পঁয়তাল্লিশেও তার দেবার বস্তু ফুরিয়ে যায় নি। এই দেবার সংজ্ঞায় ভিতরের সম্পদ এখনো পঁচিশ তিরিশের মতো তাজা আছে। এখনো সে ফলভারে আনত, ক্যামেরার ভ্রূকুটিতে নিষ্ফলা হয়ে যেতে রাজি নয়। ক্যামেরায় বয়সের দাগ পড়ে, কিন্তু সুপটু প্রসাধনে হল-ভরতি সারি। সারি স্কুল চক্ষুগুলোতে তার দাগ পড়ে না। এই মরুভূমিতে সে যে রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াবে, সে তাই। তার দেবার বস্তু নেবার জন্যেই সাগ্রহে বসে আছে সব, যতদিন দিতে পারবে ততদিন বুক ভরে আর মন ভরে নিয়ে যাবে।
বিজয়িনী নাটকে তাই নিয়ে গেছে সব। এই পঁয়তাল্লিশেও সম্পূর্ণ বিজয়িনী হয়ে ফিরেছে সে। যে বিজয়িনীর কোনো বয়েস স্থল হিসেবের মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ নয়, যে বিজয়িনীর নিভৃতের অন্তঃপুরিকাটি শাশ্বত চিরযৌবনা।
সামাজিক চক্র নাটকেও ওই বিজয়িনীকেই স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলার দ্বিতীয় অভিযান তার। ভিন্ন রূপ আর আরো একটু বিশ্বাসযোগ্য আঙ্গিকে ওই বিজয়িনীর স্বাক্ষর অপ্রতিহত রাখার অটুট অভিলাষ।
আমার বিবেচনায় বা বিচার বিশ্লেষণে চক্রের কাহিনী এমন কিছু বর্ণোজ্জ্বল নয়। বরং মামুলি আখ্যান বলা যেতে পারে। কিন্তু নাটক লোকচক্ষুর সামনে মঞ্চস্থ হবার আগেই বিজ্ঞাপনের চটকে অভিনবত্বের ছাড়পত্র পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে রামের আগে। রামকাণ্ড রচনার মতো প্রচারের আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। কাগজে সে সব চুটকি ব্যাপারগুলো ফলাও করে ছাপা হয়!… যেমন, শুধু ছায়াচিত্রের নয়, মঞ্চেরও অপ্রতিদ্বন্দ্বিনী অভিনেত্রী দিনের পর দিন মাসের পর মাস নাট্যকারের সঙ্গে বসে নিজের ভূমিকা গঠনের কাজে বিপুল সহায়তা করেছেন। সংযোজন এবং পরিবর্জনের তুলাদণ্ড হাতে বসে আপন ভূমিকাটি আত্মিক সম্পদ করে তুলেছেন। অতএব অনন্যা শিল্পীর এ যে এক স্মরণীয় সৃষ্টি হয়ে থাকবে তাতে আর সংশয়ের অবকাশ কোথায়?
নাটকের কাহিনী তখনো অজ্ঞাত আমার। বিজ্ঞাপনের ওই চমকের জবাবে মার্কা মারা এক তেরছা চরিত্রের কাগজে স্বনামে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম। লিখেছিলাম, আমাদের সাহিত্য আর নাটক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গগুণে আর সহৃদয় সহযোগিতায় কোন সার্থকতার দিকে গড়াতে চলেছে? যে নাট্যকার কোনো অভিনেত্রীর। সঙ্গে বসে তার সহযোগিতায় সৃষ্টিপথে বিচরণ করেন, নাট্যসরস্বতী তার ওপর কতটুকু নির্ভর করতে পারেন? আর নামী অভিনেতা অভিনেত্রীরাই এই সহযোগিতা দেবার স্পর্ধায় এগিয়ে আসেন কোন্ গুণে? কাব্য সাহিত্যের এই বন্ধ্যা যুগের কান্না শুনে। গিরীশ ঘোষ কি আবার রমণীর রূপ ধরে পুনর্সম্ভবামি হয়েছেন?
বলা বাহুল্য, চিঠিখানা ওই তেরছামুখো চরিত্রের কাগজে ছাপা হয়েছিল। চিঠির গুণে নয়, ছাপা হয়েছে আমার গুণে। আমার সঙ্গে ওই অপ্রতিদ্বন্দিনী অভিনেত্রীর সম্পর্কটা কাগজের কর্মকর্তাদের জানা আছে বলে। ছাপা কাগজের এক কপি যে ডাকে ওই অভিনেত্রীর কাছেও চলে গেছে তাতেও কোনো সন্দেহ থাকলে ও চিঠি ছাপাই হত না।
নাটকের মূল কথা স্বল্পপরিসরে পংক্তিবদ্ধ করা যেতে পারে।… গরিবের ঘরের এক ছেলে ডাক্তার হয়ে বসার পর এই কালের লোভের বলি হতে চলেছে। সেবার বদলে সে মৃত্যুবাণ হাতে নিয়েছে। যত তার পসার বাড়ছে, ততো তার লোভ বাড়ছে, আর কালো রাস্তাটি প্রশস্ত হয়ে উঠছে। বাধা কোথাও নেই, বাধা শুধু তার ঘরে।