আমি হেসে বললাম, বেলা চারটে থেকে আজ শুধু পথই দেখছি, এবারে বসি একটু।
ঘন্টার পর ঘণ্টা আমার টো-টো করে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর খবর রাখে। ওরা। এই নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করে। কিন্তু আজ যেন সেরকম মুড নেই ওদের।
যেখানে বসে আছি, সেই জায়গায় অনেকখানি জুড়ে আবছা অন্ধকার। আলো নেই। এক-একটা মোটর বা ট্রাক আসছে হেড লাইট জ্বেলে, সঙ্গে সঙ্গে ওদের তিন জোড়া চোখ যেন এক সঙ্গে সেদিকে ঝলসে উঠছে।
একটু বাদে দূরের আলোয় দেখলাম, মাঝারি গতিতে একটা বড় ঝকঝকে মোটর আসছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ওদের তিনজনের মধ্যে চোখের ইশারা খেলে গেল।…ওরা যে-কোনো মোটামুটি পছন্দসই শিকারের আশায় বসে ছিল। শহর কলকাতার দৈনন্দিন স্বাভাবিক ঘটনা। চোখের পলকে উঠে গেল ওরা, একজন একটা ভাঙা ঠেলা সামনে ধরতেই গাড়িটা থেমে গেল। গাড়িতে সামনে ড্রাইভার আর পিছনে মাঝবয়সী একটি মহিলা। দুজনের হাতে ঝকঝকে ছোরা উঁচিয়ে উঠল, জিতু পোদ্দারের হাতে রিভলভার।
দশ হাত দূরে রকে বসে নির্বাক মূর্তির মতো দেখছি আমি। দরজা খুলে সঙ্গী দুজন ড্রাইভারকে আগলে রাখতে চাইল, আর রিভলভার হাতে জিতু পোদ্দার পিছনের দরজা খুলে মহিলাকে প্রায় আধা-আধি টেনে নামালো। সেই সঙ্গে চাপা গর্জন, নেমে। এসে দশ সেকেণ্ডের মধ্যে গায়ে যা আছে খুলে দিন, আর সঙ্গে যা আছে দিয়ে দিন…দেরি করলে এ-জীবনে আর গয়না পরার সুযোগ পাবেন না।
আমি বিস্ফারিত চোখে দেখছি, মহিলার এক গা গয়না..সে কিছুতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে না…আমি দেখছি, একরোখা ড্রাইভারটা জোর করে নেমে এসে দুজনের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে ছোরার ঘায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে কিন্তু তখনো মনা গাঙ্গুলিকে আঁকড়ে ধরে আছে। এদিকে মহিলাকে প্রায় টেনে নামিয়েছে জিতু পোদ্দার –মহিলা ব্যাকুল ত্রাসে হঠাৎ আমাকে দেখে আর্তনাদ করে উঠল, বাঁচাও বাবা, বাঁচাও, মেরে ফেলল, বাঁচাও
সঙ্গে সঙ্গে কি যে হয়ে গেল আমার মাথার মধ্যে, কি যে বিভ্রম ঘটল আমার চোখের তারায়-মুহূর্তের মধ্যে মহিলার মুখ মুছে গেল। মনে হল, আমার মায়ের মুখখানা স্পষ্ট দেখলাম, মনে হল, আমার মাকে টেনে নামাচ্ছে–মেরে ফেলছে।…মেরে ফেলবেই জানি, কারণ ওদের বিলম্ব সয় না, কোনরকম বাধা বরদাস্ত করে না!
চোখের পলকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো জিতু পোদ্দারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। এই বাধার জন্য ও একটুও প্রস্তুত ছিল না, ওর রিভলভার আমার হাতে, আচমকা আঘাতে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলালো। মহিলাকে …না দিশেহারার মতো আমার মা-কেই আমি আবার গাড়ির মধ্যে ঠেলে ঢোকাতে চেষ্টা করলাম!
আঃ! পিঠে আমার বিধে গেল কি, সত্তা নিঙডানো যন্ত্রণা একটা। তারপরেই ঠিক ঘাড়ে আবার সেই আঘাত। মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম…মাথার ওপর আবারও জিতু পোদ্দারের ছোরা ঝলসে উঠেছে।
হাতের রিভলভার আমি সজ্ঞানে ছুঁড়েছি কিনা জানি না। জিতু পোদ্দারের ছোরা আর নামল না। আমার গা ঘেঁষেই ঢলে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর আবার একটা উদ্যত ছোরা…সামনে মনা গাঙ্গুলির মুখ…আবারও আমার হাতের রিভলভারের শব্দ। মনা গাঙ্গুলি তিন পাক ঘুরে মাটিতে পড়ল। হ্যাঁ তখনো জ্ঞান আছে আমার, জ্ঞান হারাতে দিচ্ছি না..তৃতীয় লোকটা কোথায়…মা-কে কি আমি বাঁচাতে পেরেছি?
একটা গাড়ি থামার শব্দ। লোকজন চেঁচামেচি। একটু বাদে আরো কারা যেন ছুটে আসছে। উত্তেজিত স্বরে কি বলাবলি করছে সব। রমণীর গলা কানে আসছে। কারা আমাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছে।…আমার পাশের লোকটা মরে গেছে। বলছে…পরের লোকটা নাকি উরুতে গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছে…ড্রাইভারটা জখম হয়ে অজ্ঞান হয়ে আছে…মহিলা তারস্বরে সকলকে বলছে কি…আমাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলল কারা… রমণীর নরম বুকে আমার মাথা।
আঃ! মা নাকি!
***
এই পরিণাম আমার জানাই ছিল। সেটা কবে আসবে, কখন আসবে, কোন পথ ধরে আসবে বা শেষের আসর ঠিক এই রকমই জমে উঠবে কিনা আমার চিন্তার মধ্যে সেটা বড় হয়ে ওঠেনি।…তোমরাও বড় করে দেখো না। শিউরে উঠো না।
পরিণামের এই আলোর রঙে আমার চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়ার রঙবদলের উৎসব শুরু হয়েছে। আমার এই জড় দেহের শিরায় শিরায় এক অলক্ষ্য দক্ষশিল্পী তীব্র বেদনার মীড় টেনে চলেছে। তাই দেখে বার বার তোমরা শিউরে উঠছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, এক আসন্ন প্রত্যাশার নিবিড়তায় আমার এই নিথর দেহের শিরা উপশিরার তলায় তলায় এক অদ্ভুত স্পন্দন চলেছে।
…নিজের আনন্দে বিভোর, তাই তোমাদের করুণ মুখগুলো আমি ঝাপসা দেখছি। …মা ইন্দুমতী, তোমার মুখখানা এমন পাথর কেন? এতসব সেরা অভিনয় করার পর এমন একটা সাদামাটা অঙ্কে এসে এই কাণ্ড তোমার? তুমি কি বুঝতে পারছ না, মরীচিৎকার প্রেতের নাচ শেষ করে তোমার সুমন অনেক অনেক ব্যবধান পেরিয়ে যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই ফিরে এসেছে? তুমি শিল্পী, ওপরের ওই অলক্ষ্য শিল্পীর কাজ দেখে তুমি মুগ্ধ হতে পারছ না? তাহলে তোমার পাশে তাকাও, বাবার মুখখানা দেখো, আর তার পাশে নতুন মায়ের মুখখানাও। এবার পারছ মুগ্ধ হতে? ওপরের ওই শিল্পী রসিক কত, বুঝতে পারছ?
যশোদা, তুমিও এসে গেছ! কী কাণ্ড, ঘরে তোমার গোপাল কাঁদছে না? আর শোভা মিতা তোমরাই বা খবর পেলে কি করে? রেডিও আর খবরের কাগজগুলো সব দেশ থেকে তুলে দেওয়া যায় না!