কি কাণ্ড, ও নাকি একটা ছেলেকে ভালবাসে। ভালবাসা নামে আছে বোধহয় কিছু। নইলে যশোদার মুখখানা এত ভালো লাগছে কেন দেখতে?
আসছে ফাল্গুনে ওদের বিয়ে হবে। ছেলেপুলে হবে।…যশোদার ছেলের নাম কি হবে, গোপাল? কি আশ্চর্য, মাথাটা কি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল আমার!..যশোদার গোপালের মুখখানা আমি চোখের সামনে এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কি করে? গোপাল হাসছে খলখল করে, যশোদা হাসছে, ওদের হাসিতে আমার স্নায়ুগুলো সব যেন ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
***
অন্ধকারে গাড়ি ছুটছে। যশোদা আমার পাশে নির্বাক বসে। ওর দিকে তাকিয়ে এখন আমার কেমন হাসি পাচ্ছে।
বাড়ি। আমার মায়ের বাড়ি। রাত তখন একটা, কিন্তু বাড়ির সব আলো জ্বলছে। গেটের সামনে গাড়ি থামতে যশোদা নেমেই ভিতরে ছুটল। আধা-আধি গিয়েই থমকে ফিরল! আবার আমার দিকে আসছে। আমাকে নামিয়ে নিতে আসছে। দোতলার বারান্দায় কারা ছুটে এসে দাঁড়াল? মা আর তার দুই আয়া বোধ হয়।
সুমনদা, নামো শীগগির!
ওকে বিষম চমকে দিয়ে আমি গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলাম।
কি এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে কেটে গেল রাতটা। সকালে জিতু পোদ্দারের বাড়ি এলাম। আমাকে দেখে ও হাঁ। মক্ষীরাণীকে ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছি শুনে ওর চাউনি ক্রুর হয়ে উঠল। পরে ওর দলবল আসতে তারাও ক্রুদ্ধ। সকলেরই অবিশ্বাস।
ওদের ঠাণ্ডা করতে পাঁচশ টাকা খেসারত কবুল করলাম আমি। চরিত্র জানি, দুনিয়া টাকার বশ।
কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত আর স্থির থাকতে পারলাম না। মা-কে নয়, যশোদাকে দেখার। এত লোভ আর কখনো হয়নি। বোকার মত কাল পালিয়ে এলাম কেন? সমস্ত দিন এভাবে না কাটিয়ে দাদা তার বোনের কাছে গিয়ে হাজির হলেই তো পারতো! এতক্ষণ। গেলাম না কেন?
গেট বন্ধ। গেটের সামনে দারোয়ান দাঁড়িয়ে। ঠাণ্ডা পালিশ করা মুখ যেন তার। যা বলল–তার সারমর্ম, মাইজি আমাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দিতে নিষেধ করেছে।
পায়ের নিচে মাটি এত দুলছে কেন? মাথাটাই বা এ-ভাবে ঘুরছে কেন? বড়রকমের ভূমিকম্প-টল্প হচ্ছে কিছু?
***
জীবন কি? দুর্নিরীক্ষ্য কোনো অদৃষ্টকারের ছকে বাঁধা পরিকল্পনা কিছু? সেকরম কোনো শক্তির অস্তিত্ব আমার জানা নেই। এর থেকে আর এক দার্শনিক জীবন-সংজ্ঞা মনে। রেখাপাত করে… আমাদের জীবন একখানা ডায়েরির খাতা। এতে আমরা এক গল্প লিখতে চাই কিন্তু লিখে বসি আর এক গল্প। আমাদের সব থেকে বিনীত মুহূর্ত সেইটি, যা লিখেছি আর যা লিখতে চেয়েছিলাম, এই দুই-ই পাশাপাশি চোখের সামনে রেখে শান্ত মনে বিচার করতে পারি।
আমার সঙ্গে মেলে। আমার এক গল্প লেখার কথা, আর লিখে বসেছি অন্য। জনারণ্যের মধ্যে থেকেই জীবন সার্থক করার সমস্ত রসদ আমার নাগালের মধ্যে ছিল। অথচ জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের এই আল্ বাঁধা ক্ষেতে আমি এক নিঃসঙ্গ পথিক নিজের গড়া অন্ধকার সমুদ্রে ছোট এক জোনাকির মতো আশা আর নিরাশায় টিপটিপ করে। জ্বলেছি আর নিভেছি।
ভবিতব্য অনেক সময় আগে-ভাগে নাকি তার ছায়া ফেলে। আজ দুবছর ধরে সেই ছায়া আমি অহরহ দেখতে পাচ্ছি। সেটা নড়ছে দুলছে আর খুব ধীরে অথচ অব্যর্থ গতিতে কাছে এগিয়ে আসছে। আসছেই। আমার নিঃসঙ্গ যাত্রা পরিণামের এক স্থির তটের দিকে এগিয়ে আসছে আর আমি যেন নিশ্চিত জানি, এ-যাত্রার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে।
কিন্তু কেমন করে কোন পথ ধরে এ-শেষ হবে, আমার কোন ধারণা নেই। এ নিয়ে মাথা ঘামাই নি। জীবনের এই বিনীত মুহূর্তটিকে৷ এ-সব ভাবনা দিয়ে অত ভারাক্রান্ত করতে চাই নে।
তিন বছরের মধ্যে মায়ের সঙ্গে আর দেখা করিনি। মায়ের সঙ্গে দেখা একবার অবশ্য হয়েছে যশোদার বিয়ের রাতে। মা ত্যাগ করলেও ওই মেয়েটা আমাকে ছাড়তে পারেনি। নিজে এসে আমাকে নেমন্তন্ন করেছে, যাবার জন্য ঝোলাঝুলি করেছে। গেছি। বিয়ের জন্য মস্ত একটা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল, সেই বাড়িতে গেছি। পরের বছর ওর একটা ছেলে হয়েছে। যশোদার গোপাল, গোপালকে ও বাড়িতে এনে আমাকে দেখিয়ে গেছে। আমি ওদের শুভ কামনা করেছি। শুভ কামনার সেই স্বাদও আগে কখনো টের পাই নি।
আশ্চর্য, মায়ের দরজা আমার সামনে বন্ধ হয়ে গেছে, সেই জন্যে আর আমার একটুকু রাগ নেই ক্ষোভ নেই। শুধু একটুকু অভিমান যেন মনের কোণে লেগে আছে। তার বেশি কিছু নয়।
আমি শুধু এই নিঃসঙ্গ যাত্রার শেষ লগ্নের প্রতীক্ষায় বসে আছি। মন কেবলই বলছে, আর খুব দেরি নেই।
কিন্তু শেষের সেই মুহূর্ত হঠাৎ যেন একটু আড়ম্বর করেই এসেছে। কিন্তু এসেছে বড় অনায়াসে। খবরটা খুব জাঁকজমক করে কাগজে বেরিয়েছে বোধহয়, কিন্তু আমার মতে শেষ শেষই-কেমন করে এলো তা নিয়ে অত ঘটা কেন?
জিতু পোদ্দারের দল এই তিন বছরে দ্বিগুণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। প্রয়োজনে অনায়াসে জীবন ছিনিয়ে নেবার খেলায় মেতে উঠেছিল ওরা। ওর প্রধান সাগরেদ মনা গাঙ্গুলি ও আরো দুজন।
জিতু আর আমার দুজনের জীবনের খেলাই যে একসঙ্গে ঘনিয়ে এসেছে, আচমকা। ঘটনাটা ঘটে যাবার পাঁচ মিনিট আগেও কেউ জানতুম না…রাতে দক্ষিণের এক নির্জন রাস্তায় ওদের চারজনের তিনজনকে একটা বন্ধ দোকানের রকে বসে থাকতে দেখে আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল, ওদের কিছু মতলব আছে। আমাকে দেখে জিতু বলেছিল, তুমি আবার মরতে এ-সময় এখানে কেন, পথ দেখো না।