আমার কান দুটো আবার জ্বলে যেতে চাইছে বলেই ভিতরে ভিতরে আরো নৃশংস আমি। জিতু শক্ত হাতে ওর মুখ চেপে ধরে গলা বন্ধ করে দিল। তারপর কোমরে। গোঁজা রিভলভারটা টেনে বার করে দেখালো। অন্যহাতে ওর কাঁধ ধরে দুটো ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, মেয়েছেলে খুন করার সাধ নেই, কিন্তু দরকার হলে বাধাও নেই– বুঝে-শুনে অবাধ্য হয়ো।
যশোদা আবার নির্বাক, স্তব্ধ। এর পরেও ও শুধু আমার দিকেই চেয়ে আছে। কেন! বিরক্তিকর!
এতবড় সৌভাগ্য জিতু আর তার সঙ্গীরা কল্পনাও করতে পারে নি। লোলুপ চোখে ওরা যেন সর্বাঙ্গ জরিপ করছে মেয়েটার। পারলে এখনি ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে খায়। এই রাতেই ওরা সর্বনাশ করবে মেয়েটার, আমি ওকে রক্ষা করতে পারব না।
বিরক্তিকর! রক্ষা করার কথা ভাবতে যাচ্ছি কেন? রক্ষা করব বলে ধরে এনেছি! তবু হঠাৎই এক বিপরীত প্রতিক্রিয়া মাথার মধ্যে ওঠা-নামা করতে লাগল। তাড়াহুড়োর ব্যাপারটাই শয়তানের অনুকূল, মায়ের বুক খালি করবই আমি, কিন্তু তবু এদের হাতে মেয়েটাকে আজই সঁপে দিতে মন চাইল না। মাঝে একটু কিছু যেন ভাবার আছে। যা করার কাল করব, সঁপে দিতে হয় কাল দেব…আর সঁপে যদি দিতেই হয় তাহলে…
লুব্ধ চোখে তাকালাম যশোদার দিকে। আমন্ত্রণ পেয়ে শয়তান এবার আমাকেই ঠেলে দিতে চাইল ওর দিকে। কিন্তু ভিতর থেকে প্রচণ্ড বাধা দিচ্ছে কে?
গম্ভীর মুখে জিতু পোদ্দারকে লক্ষ্য করে সকলের উদ্দেশেই বললাম, শোনো, আনন্দে আটখানা হবার সময় নয় এখন, আনন্দ পরে করো। আর একটুও দেরি না করে বাস ধরে যে যার বাড়ি চলে যাও!
ওরা সবিস্ময়ে একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল।–সে কি! কেন?
বললাম, একটু বুদ্ধি খরচ করলেই বুঝবে, কেন।…তোমাদের মক্ষীরাণীকে আমি বাড়ি থেকে নিয়ে বেরিয়েছি, সকলেই জানে, রাত বেশি হলে মা পুলিশে খবর দেবে, পুলিশ আমাকে না পেয়ে আমার অন্তরঙ্গ সঙ্গী সাথী অর্থাৎ তোমাদের খোঁজ করবে। সেই খোঁজ করার আগে তারা যেন তোমাদের প্রত্যেককে বাড়িতে পায়, খোঁজ নিতে এলে তাদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে দেবে। বলবে, একটা মেয়েকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনের দিকে যেতে দেখেছ, কিংবা উত্তর কলকাতার দিকে।
ওরা হকচকিয়ে গেল কেমন। জিতুর সঙ্গীরাও ঘাবড়াল হয়তো একটু। কিন্তু জিতু পোদ্দার বলল, আমরা যদি সকলে মিলে তোমার মতই গা-ঢাকা দিয়ে থাকি?
কদিন থাকবে, খাবে কি? তাছাড়া আমার মায়ের কত টাকা তোমরা জানো না–দরকার হলে হাজারখানেক পুলিশ সমস্ত জায়গা চষে ফেলবে। আর দেরি করো না, চলে যাও, কাল বেশ বেলাবেলি এসো, পরের ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে।
জিতু জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এই মেয়েটাকে তোমার মায়ের কাছ থেকে ধরে এনেছ নাকি?
হ্যাঁ।
আমার বলার মধ্যে বা চোখে মুখে এমন কিছু ছিল, যা ওরা একটুও অবিশ্বাস করল না। তাছাড়া ঠিক যে ভাওতা দিয়েছি ওদের, তাও নয়। কেবল এই রাতটার মতো সরাতে চেয়েছি ওদের।
যাবার আগে জিতু আমার কানে কানে অশ্লীল প্রশ্ন করল একটা। আমি মাথা নাড়লাম, অর্থাৎ সেই রকমই ইচ্ছা।
জিতু মুখ দিয়ে কুৎসিত চুকচুক শব্দ করল। তারপর চোখ দিয়েই যশোদার সর্বাঙ্গ লেহন করে বাকি তিনজনকে নিয়ে চলে গেল।
এত ত্রাসের মধ্যেও যশোদা যেন স্বস্তি বোধ করল একটু। তাই দেখে আমার আরো রাগ হয়ে গেল। মাথার আগুন নিভবে ভেবেছিলাম কিন্তু আরো যেন দ্বিগুণ জ্বলছে। ঘরের মধ্যে পায়চারি করছি আর কি-যে উল্টো-পাল্টা চিন্তা করছি, বুঝতে পারছি না।
সুমনদা!
ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। সরোষে তাকালাম ওর দিকে। যশোদা প্রাণপণে সাহসে বুক বাঁধতে চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছি। কিন্তু এটুকুও আমি তচনচ করে দিতে চাই। অথচ পারছি না কেন?
এদিকে এসো, বোসো।
সামনে এলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম। নির্দয় চোখে তাকালাম।
সুমনদা তুমি এত নিচে নেমে গেছ! আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না!
বিশ্বাস করো! তাহলে যন্ত্রণা কমবে।
না না, বিশ্বাস করব না, তুমি এ-কাজ কেন করলে?
মায়ের বুক খালি করার জন্যে।
ও স্তব্ধ একটু। তারপর আকুতিভরা সুরে বলল, সুমনদা তোমার মাকে আমি মা বলি, উনি আমার কাছে মায়ের থেকেও বড়–তাই তুমিও আমার কাছে দাদার থেকে বেশি কিছু।
কানে যেন গলানো সীসে ঢুকল এক প্রস্থ। সরোষে জবাব দিলাম, এটা অভিনয়ের জায়গা নয়, বুঝলে? ধুপ করে বসে হ্যাঁচকা টানে ওকে বুকে টেনে আনলাম।
আমি কেমন দাদা, এই রাতেই টের পাবে সেটা।
যশোদা আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। কেন যে ছাড়লাম, কেন যে নৃশংস পাষণ্ড হয়ে উঠতে পারছি না, আমার সেই রাগ সেই যন্ত্রণা।
বসন একটু সম্বৃত করে নিয়ে ও সোজা মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। আস্তে আস্তে বলল, সুমনদা, একটি ছেলেকে আমি ভালবাসি, মা বলেছে, আসছে ফাল্গুনে। তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে.. তুমি কি আমাদের দুজনকেই পাগল করে দেবে? আমাকে দয়া করতে পারো না?
কি হল আমার! আষ্টেপৃষ্ঠে এত চাবুক চালাচ্ছে কে? ভালবাসা আবার কি জিনিস? যশোদার ওই ঠাণ্ডা চোখের সামনে আমি বসে থাকতে পারছি না কেন? এই কাণ্ড করে বসে ওরা সব ঠিক থাকল, মাঝখান থেকে আমার মাথাটাই শুধু গণ্ডগোল হয়ে গেল?
উঠলাম। ঘরের মধ্যে আবার পায়চারি করতে লাগলাম। মাথায় জমাট বাঁধা আগুন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে কোন যাদুমন্ত্রে? পায়চারি করছি আর মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকাচ্ছি। যশোদা অপলক চোখে আমার দিকেই চেয়ে আছে। ওর মুখখানা এত সুন্দর লাগছে কেন এখন? দাদার মতই সামনে গিয়ে ওকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। কেন একটু?