এটাই ওপরতলার কারসাজি। শয়তানের এই টোপ যে শুধু আমার উদ্দেশেই ফেলা, কি করে বুঝব। নেশা শুরুর মুখে মনের মতো আলোচনার রসদ পেয়ে ওরা উদ্দীপিত। হৈ-হৈ করে সকলে গুরুর প্রস্তাবনার তারিফ করল। সকলে একবাক্যে স্বীকার করল, সুশ্রী চালাক-চতুর একটি মক্ষীরাণী সংগ্রহ করা গেলে কারবার জামিয়ে তোলা যায় বটে। কিন্তু আসল সমস্যা তেমন মক্ষীরাণী জোটানো যায় কি করে।
আমার মগজের মধ্যে অদ্ভুত দাপাদাপি শুরু হয়ে গেল তক্ষুণি। মায়ের ওই অভিনয়ের পুরস্কার দিতে হবে…একটাই পুরস্কার তার যোগ্য। যশোদাকে তার বুক থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে, ছিনিয়ে নিয়ে মায়ের বুক আরো খালি করে দিতে হবে। এটুকু পারলেই শুধু আমার মাথার আগুন বুকের আগুন নিভবে। সব জ্বালা যন্ত্রণা জুড়োবে।
ঘোলাটে চোখে তাকালাম ওদের দিকে। অপ্রত্যাশিত উক্তি শুনে ওদের নেশা চটে যাবার দাখিল।
আমি পারি জুটিয়ে দিতে, কিন্তু তোমরা তাকে আগলে রাখতে পারবে? মক্ষীরাণী বানাতে পারবে?
এক নিঃশ্বাসে গেলাস খালি করে জিতু পোদ্দার বলল, জান কবুল, পারলে সেদিন থেকে তুমিই আমাদের গুরু। সত্যি পারবে, না মদের ঝেকে বলছ?
আমি মাথা নাড়লাম। সত্যি পারব। তোদের হাতের মুঠোর মধ্যে এনে দেব।
জিতু পোদ্দারের তবু সংশয়, কেমন দেখতে?
তোমরা যা আশা করছ তার থেকে ভালো।
ওদের বুকের তলায় একটা উত্তেজনার ঝড় বইতে লাগল যেন। শুধু মনা গাঙ্গুলি হাঁ করে দেখছে আমাকে। ভাবছে, হয়ত বোনের দুঃখে দরাজ হাতে আট হাজার টাকা দিয়ে ফেলতে পারে যে তার মুখে এই প্রস্তাব সম্ভব কি করে।
জিতু বলল, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, হাতের মুঠোয় যদি তেমন মেয়ে পাই, দরকার হলে পিষে ফেলেও মক্ষীরাণী বানিয়ে ছাড়ব।
পরদিন সকালে জিতু পোদ্দার আর বাকি তিনজনের সঙ্গে বসে ঠাণ্ডা মাথায় সমস্ত ব্যবস্থার প্ল্যান হয়ে গেল।
দুটো নিস্তরঙ্গ নিথর দিন কেটে গেল।
তৃতীয় দিনে মা স্টুডিওয় গেছে, খবর পেলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমি তার বাড়িতে হাজির। মেক আপ তুলে মায়ের বাড়ি ফিরতে সাড়ে ছটা।
যশোদা আমাকে দেখে একমুখ হেসে এগিয়ে এলো। আমার বরাদ্দ চা জলখাবার এসে গেল। ও এটা সেটা গল্প করতে লাগল।
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। আমি প্রস্তাব করলাম, চলো একটু বেড়িয়ে আসা যাক, সঙ্গে গাড়ি আছে।
যশোদা অবাক আবার খুশিও। একটু বসুন না, মা ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই এসে যাবে।
তাহলে তুমি থাকো, আমি চললাম।
ওমা সে-কি, মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন না?
আমি রাগত মুখে বললাম, তুমি দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আমার সঙ্গে বেরুবে কি না?
যশোদা ঘাবড়েই গেল। আমার খামখেয়ালী স্বভাব জানে। সমীহও করে। আমাকে খুশি রাখতে মায়ের থেকে কম চেষ্টা করে না সেও! তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা আসছি, বসুন–
***
গাড়ি আমি চালাচ্ছি। ফাঁকা রাস্তায় গতির কাটা পঞ্চাশ মাইলের দাগ ছুঁয়েছে। পাশে যশোদা বসে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি ওর কাছে বরাবরই একটা বিস্ময়–এমন গাড়ি চালাই, সেটাও। ও জানে না, স্কুলে পড়তেই মায়ের গাড়ি আমি কত চালিয়েছি। আর জোরে চালিয়ে মায়ের কত বকুনি খেয়েছি। কথা-বার্তা এতক্ষণ ওই বলছিল এক তরফা। তারপর ক্রমে ওর অস্বস্তি বাড়ছে, টের পাচ্ছি।
চলেছেন কোথায়?
সমুদ্রের হাওয়া খেতে।
আঁ, এতদূর! না না, আর একদিন যাব, ফিরুন, যেতেই রাত হয়ে যাবে, মা ভাববে।
আমার সঙ্গে এসেছ, সকলেই জানে, কিছু ভাববে না।
যশোদার মুখের হাসি আগেই কমে গেছল। ক্রমে কথাও বন্ধ হল। ওর মুখ শুকিয়ে গেছে, সন্দিগ্ধ চাউনি।
গন্তব্যস্থানে পৌঁছুলাম যখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। একটা ভাঙা নির্জন বাগান বাড়ির খোলা ফটকের মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম। যশোদা আঁতকে উঠল।–এ কোথায় আনলেন আমাকে?
আমি হাসলাম এবারে। বেশ ভালো জায়গা।
ভাঙা গাড়ি-বারান্দার নিচে গাড়ি থামতে জিতু পোদ্দারের দল তিনটে বড় বড় টর্চ হাতে দৌড়ে এলো। আমি নেমে এসে এদিকের দরজা খুলে যশোদাকে হাতে ধরে টেনে নামালাম। তারপর জিতু পোদ্দারের দিকে ঠেলে দিলাম। এই নাও মক্ষীরাণী।
তিনটে টর্চই যশোদার নির্বাক বিবর্ণ মুখের ওপর জ্বলে উঠেছে। ওদের চোখে মুখে চাপা উল্লাস। টর্চ নিভে গেল। জিতু খপ করে যশোদার একটা হাত ধরে ভিতরের দিকে টানল, চলো গো সুন্দরী, কিছু ভয় নেই!
পিছন ফিরে অন্ধকারে আমার দিকে চেয়ে যশোদা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, সুমনদা!
আমার কানের ভিতরটা জ্বলে যেতে চাইল বটে কিন্তু জ্বলতে দিলুম না।
সামনে মস্ত ঘর। দরজা-জানালা বন্ধ, ভিতরে পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে। পাশের র দুটোয় হারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। যশোদাকে বড় ঘরে টেনে এনে মাঝের গদি-আঁটা ময়লা ফরাসের ওপর জোর করে বসিয়ে দিল জিতু। তারপর খুশির আতিশয্যে আমার পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করল। দেখাদেখি বাকি তিনজনও।
ভয়ে কণ্টকিত যশোদা বিস্ফারিত নেত্রে আমাকে দেখছে। আমার মুখে শয়তানের হাসি দেখছে বোধহয়।
বললাম, এতদিন একরকমের অভিনয় করেছ, এখন মক্ষীরাণী হয়ে ঢের বেশি বাস্তব অভিনয় করবে, অত ঘাবড়াবার কি আছে?
যশোদা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, তারপর চিৎকার করে বলতে লাগল, আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে এসো সুমনদা, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে এসো–