যে উপলক্ষ নিয়ে আমি আচমকা পাগলের মতো কাণ্ড করে বসলাম, সেও মায়ের নতুন একটা ছবি। ছবিটার প্রশংসায় সমস্ত কাগজগুলো পঞ্চমুখ। দিনের পর দিন হাউস ফুল যাচ্ছে। দেখব দেখব করেও দেখা হয়ে ওঠে নি অনেক দিন। যশোদা কতবার বলেছে, শিল্পী কাকে বলে মায়ের এই ছবিতে দেখে আসুন।
টিকিট পেয়ে সেদিন হঠাৎ ঢুকে পড়েছিলাম। ফলে মানসিক প্রস্তুতির অভাব ছিল। ছবিটা যতো দেখছি, শরীরের সমস্ত রক্তকণাগুলো যেন ফুটে ফুটে মাথার দিকে ধাওয়া করছে আমার। কাহিনীর বিষয়বস্তু এক মদ্যপ স্বামীর সংশ্রব ত্যাগ করে পাঁচ বছরের ছেলে নিয়ে নিরুদ্দেশ তার তেজস্বিনী মা। তার একমাত্র সঙ্কল্প–ছেলেকে বাপের মতো হতে দেবে না, তাকে সে নিজের আদর্শে মানুষ করবে। কিন্তু অন্তরায় তার বয়স, অন্তরায় তার রূপ যৌবন। আশ্চর্য সুষমামণ্ডিত তেজে এই সব অন্তরায়। সে প্রতিহত করতে পেরেছে। কিন্তু বিধাতার নির্মমতম পরীক্ষা সামনে তখনো। ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ল, তার জীবন সঙ্কট। হাসপাতালের যে বিরাট ডাক্তারটির ওপর প্রধান নির্ভর, সেই মানুষটি এক প্রবল পুরুষ-রমণীর প্রতি যার সজাগ চুলচেরা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি রমণীর মহিমা আবিষ্কার করতে জানে। নামজাদা সেই ডাক্তার পুরুষের মতই সবল হাত বাড়িয়েছে ছেলেটির মায়ের দিকে।…একদিকে ছেলের জীবন, অন্যদিকে সত্তার সংঘাত। মহিলা এই মদ্যপ স্বামীকেই ভালবাসে, ছেলের ভিতর দিয়ে আদরে একটা সাদা নজির রেখে যেতে চায় তার কাছে। শেষ পর্যন্ত বিচিত্র সংঘাতের মধ্যে দিয়ে আদর্শেরই জয়, মহিলার নিখাদ রমণীসত্তা এক শুচিশুভ্র দীপ্ত মাধুর্যে ভাস্বর –প্রবল পুরুষ সেই ডাক্তারও অবনতমস্তক তার কাছে…সুস্থ ছেলের হাত ধরে সে যখন বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যাচ্ছে, নামজাদা সেই ডাক্তারের দুচোখ আনন্দে চিকচিক করছে, সে তার সহকারীকে বলছে, এমন মা-ও যে দেশে আছে, সে দেশের দুর্ভাগ্য, কে বলে?
সেই ছবি দেখার পর সমস্ত রাত আর তার পরদিন সমস্ত সকাল আমার মাথায় দাউদাউ আগুন জ্বলেছে শুধু। দুপুরের দিকে অসহ্য লাগতে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম। আশা করছি, বাড়িতেই পাব, মাকে, গত রাতে নতুন মা বলছিল, দিদির জ্বর হয়েছে একবার দেখে আসি, চল।
আমি কেন চলেছি, কৈফিয়ত নিতে? মায়ের সঙ্গে যে অদৃশ্য বন্ধনটুকু আছে, নির্মমভাবে সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিতে? নাকি জীবনের এতবড় মিথ্যেকে অভিনয় করে এমন সত্যের রূপ দিতে পেরেছে বলে কনগ্রাচুলেট করতে?
আমি জানি না, কেন যাচ্ছি। ভিতরটা কি যেন এক চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আঘাত হানার জন্য অস্থির কঠিন।
দারোয়ান চেনে, সে সেলাম ঠুকল। দোতলার সিঁড়ির বারান্দার দূরের কোণে আয়া দুটো তকতকে মেঝেতে পড়ে ঘুমুচ্ছে। নিঃশব্দে পর্দা সরিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকলাম।
তারপরেই চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম।
পার্লঙ্কে শুয়ে মা ঘুমুচ্ছে। তার একদিকের কাঁধে মাথা রেখে বলতে গেলে প্রায় বুকের ওপর শুয়ে যশোদা ঘুমুচ্ছে। ওর একটা হাত মায়ের বুকটা বেষ্টন করে আছে। মায়ের বুকে যশোদা আধাআধি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
অপলক চোখে দেখছিলাম। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সজাগ হলাম। ঝাঁকুনি নয়, শয়তানের চাবুক, মগজের মধ্যে শয়তানের কাটাছেঁড়া। শরীরের রক্ত এখন বুঝি চোখ দিয়ে ফেটে বেরিয়ে মুখের দিকে গড়াবে। নিজের রক্তের নোনা স্বাদ আমি আগেই পাচ্ছি কেন?
যেমন এসেছিলাম তেমনি নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। দারোয়ানটা এরই মধ্যে আমাকে চলে যেতে দেখে অবাক হল একটু।
না, আমার মাথায় বুকে সর্বাঙ্গে এমন আগুন আর কখনো জ্বলে নি। এ-আগুন আমি নেভাতে চাইনে, এ-আগুনে আমি সব কিছু ধ্বংস করতে চাই।
অপ্রত্যাশিত সুযোগ মিলল। মাথা ঠাণ্ডা থাকলে ওপর-অলার এ-চক্রান্ত ধরতে পারতুম। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা আর বোধহয় এ-জীবনে হবে না।
ঘুরতে ঘুরতে জিতু পোদ্দারের আড্ডার জায়গায় এসেছি। তখন বিকেল। আমাকে দেখে ওরা আনন্দসূচক ধ্বনি ছাড়ল একটা। জিতু বলল, চাঁদুর যে দেখাই নেই। আজকাল, বলি প্রেমে-টেমে পড়লে নাকি কারো?
ঘরে তখন চারজন ছিল ওরা। ওদের কাছে আমার এখন মান খুব। শোভা গাঙ্গুলির বাপের হাতে আট হাজার টাকা দিয়েছি। মনা গাঙ্গুলি সেটা এদের কাছে গোপন রাখে নি। জিতু আড়ালে আমাকে বলেছিল, একটা মেয়ের জন্য আট হাজার–ওই টাকায় যে অমন আটটা মেয়ে ঘায়েল করা যেত, দোস্ত…।
এরপর থেকে আমার টাকার সম্বন্ধে ওরা নিজেদের মধ্যে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছে, বুঝতে পারি। আমাকে দেখলেই সকলে ঘেঁকে ধরে, ভালো-মন্দ একটু হয়ে যাক, বন্ধু
ওদের ভালো-মন্দ মানে মদ। জিতুর বাছাই দলকে অনেকদিন বার-এ নিয়ে গেছি। ওদের সঙ্গে আমিও গিলেছি। তরল পদার্থ বুকের ভিতরটা জ্বালিয়ে দিয়ে জঠরে নেমেছে। এটা মন্দ লাগে না। একটা যন্ত্রণা দিয়ে আর একটা যন্ত্রণা ঘায়েল করার মতো। পরে আরো ভালো লাগে।
সেদিনও আপত্তি না করে বার-এ নিয়ে গেলাম। আমার নিজেরই দরকার ছিল।
ওদের আনন্দ সবে জমাট বেঁধেছে তখন। জিতু হঠাৎ বলল, কারবারে মন্দা পড়েছে এখন, শালারা সেয়ানা হয়ে উঠেছে, দলে একটা মক্ষীরাণী থাকলে বেশ হত, টোপ ফেলে অনেক মক্কেল ঘায়েল করা যেত, নিজেদেরও আনন্দে কাটত।