জীবনযন্ত্রণার একটা বদ্ধ গুমোট থেকে বেরিয়ে এলাম যেন। কিন্তু বাড়ি আসার পরেই সেই যন্ত্রণাটা মগজে ঘুরপাক খেতে থাকল। বাবার ঘরে উঁকি দিলাম একবার। চেয়ারে মাথা রেখে নেশাটা উপভোগ করছে।
পরদিন সকালে সোজা তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমার কিছু টাকা দরকার।
বাবা রীতিমতো অবাক, কারণ সামনাসামনি টাকা চাওয়া এই প্রথম। কত?
আট হাজার।
কত! নিজের কানের ওপর হঠাৎ যেন বিশ্বাস হারালো বাবা।
আরো স্পষ্ট করে বললাম, আট হাজার।
বাবা হতভম্ব খানিক। আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল একবার। অত টাকা কি জন্যে দরকার?
দরকার আছে, টাকাটা আজই ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনতে ভুলো না।
বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল একেবারে, কি দরকার না বললে এক পয়সাও পাবে না, বললেও পাবে কিনা সেটা আমি বিবেচনা করে দেখব। মুখের কথা খসলেই আট হাজার টাকার বৃষ্টি হয়ে যাবে, কেমন? আট টাকা রোজগার করে দেখেছ কখনো?
সরোষে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অর্থাৎ আর কোনো কথা নেই।
খুব ঠাণ্ডা স্বরে বললাম, আমার দলের ছেলেরা আমার জন্যেই আজও তোমার কাছে টাকার দাবি করে নি, তারা চাইলে আট হাজারের ঢের বেশিই চাইত। আমার আপত্তি না থাকলে তারা কম করে হাজার পঁচিশেক আদায়ের ব্যবস্থা করবে।
বাবা সন্ত্রাসে ফিরে তাকালো আমার দিকে। খবরের কাগজ সেও পড়ে। টাকা। ওদের দিতে হবে?
না, আমার-ই দরকার।
বাবা গর্জন করে উঠল, আমাকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতে এসেছিস? তোদের সকলকে পুলিশে দেব আমি!
চেষ্টা করে দেখো!…টাকাটা আজই চাই! আজ নবছর হল আমার বাড়িতে আছ, খুব কম হলেও মাসে সাড়ে সাতশ টাকা ভাড়া হবে এর–এক বছরেই আমার নহাজার টাকা পাওনা হয়। এই আট হাজার বাদে মাসে এরপর অন্তত পাঁচ শ টাকার অর্ধেক আমার নামে কালই ব্যাঙ্কে-জমা করে দেবে।
নিজের ঘরে চলে এলাম। নতুন মা হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। বিকেলে সে-ই আমাকে টাকা এনে দিল। বাবার আর আমার মুখ দেখতেও আপত্তি বোধ হয়।
***
আট হাজার টাকা পেয়ে শোভা গাঙ্গুলির বাবা পাগলের মতো করতে লাগল। হাসছে কাঁদছে আর আমাকে বারবার জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করছে। শোভার মা, কাকা আর শোভা নিজেও বাকশক্তিরহিত যেন। আমার মাথায় কিছু গণ্ডগোল আছে কিনা তাই যেন সন্দেহ তাদের। শোভার বাবা বলছে, কেমন, বলেছিলাম না, ভগবান ঠিক আবার মুখ তুলে তাকাবে।
শোভার মায়ের কোটরাগত চোখে চাপা শঙ্কা। আমাকে আড়ালে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করল, তুমি অত টাকা দিচ্ছ কেন, বাবা?
হেসেই জবাব দিলাম, মনে করুন, শোভার কোনো দাদার কিছু টাকা আছে, সে দিয়েছে।
মহিলার দুচোখ অস্বাভাবিক চকচক করতে লাগল।
শোভার কাকাও কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, টাকাটা ঠিক কি শর্তে দিলেন, বুঝলাম না…
বিরক্তিকর। মোলায়েম সুরেই জবাব দিতে হল, ছেলে-মেয়েগুলো আর শোভা লেখা-পড়া শিখে মানুষ হবে, এই শর্তে।
ভদ্রলোক হা করে আমাকে দেখতে লাগল।
এই গুমোটের মধ্যে বাতাস টানতে কষ্ট হচ্ছিল। বেরিয়ে এলাম।
সুমনদা!
অন্ধকার গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। পিছন থেকে শোভা বেশ কাছে এসে বলল, আপনি কি অদ্ভুত মানুষ!
একটা তপ্ত নিঃশ্বাস আমার মুখে লাগল। ও এবার ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে স্টুডিওতে কবে যেতে হবে?
মাথাটা আমার খারাপ কিনা আমার নিজেরই মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। জবাব না দিয়ে অন্ধকার গলির মধ্যে অত বড় মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে। দিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছি।
বাড়ি ফিরে নিজের অনুভূতিপ্রবণতার বহর দেখে নিজেরই হাসি পেয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলেছি, সুমন সরকার তুমি একটা গাধা।
অথচ ভিতরে ভিতরে ঠিক তারপর থেকেই ঠাণ্ডা পরিবর্তন এসেছে একটা। আমার ক্রুর অভিলাষের আওতা থেকে শুধু শোভা নয়, মিতাও কেমন যেন মুক্তি পেয়ে গেছে। শোভা এখনো আসে মাঝে মাঝে। কৃতজ্ঞতায় ভরাট মুখ। অন্ধকার গলির সেই চড়টা যেন ওর যোগ্য পুরস্কার।
মিতা বোসের আরো অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে আপত্তি নেই। মা ওকে দস্তুর মতো আশাই দিয়েছে। ওর কৃতজ্ঞতার ধরন-ধারণ অন্যরকম। লক্ষ্যে পৌঁছুবার জন্য ও যেন যে কোনো মাশুল দিতে প্রস্তুত।…না, মাশুলও ঠিক নয় হয়তো, ও সানন্দে আশা করছে, ভবিষ্যতে ওর সঙ্গে কোনো বড় সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। চালাক মেয়ে, এখন একাই মায়ের সঙ্গে দেখা করে। আমার প্রতি মায়ের দুর্বলতাটুকু ও হয়তো আঁচ করতে পেরেছে! মনে মনে তাকেও আমি অব্যাহতি দিয়েছি। আমার ঠোঁটের সেই লিপস্টিকের দাগ আজও ভালো করে উঠল না, এমন একটা অসম্ভব অস্বস্তি বোধ করি মাঝে মাঝে।
সেদিন মিতা বলল, সুমন, তুমি আমাকে ঠিক আগের মতো পছন্দ করো না।
আমি অস্বীকার করি নি।ঠিকই ধরেছ।
ও আহত মুখে জিজ্ঞাসা করল, কেন করো না?
আমি জবাব এড়াতে চেষ্টা করেছি।–তা ঠিক বলতে পারব না, হয়তো আগের থেকে আমি একটু উদার হয়ে পড়েছি।
ও পরিহাস ভেবে হেসেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি কেমন বিরক্ত বোধ করেছি।
দিন কাটে। নিজের অস্তিত্বটাই বোঝার মতো মনে হয় এক এক সময়। ভাবি, আমি না জন্মালে এত বড় দুনিয়াটার কি ক্ষতি হত? মায়ের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ আগের থেকেও কমিয়ে দিয়েছি। তার ছবিগুলো কিন্তু খুঁটিয়ে দেখি : প্রায় সমস্ত ছবিতেই রমণীর মাধুর্যের দিকটা বিশেষভাবে প্রতিভাত। এই বিশেষত্ব যে গল্পে নেই, সেই ছবিতে মা অভিনয়ই করবে না। অথচ রমণী চরিত্রের এই বৃহৎ দিকটা দেখলেই ভিতরে ভিতরে এক অন্ধ আক্রোশে ফুলতে থাকি আমি। মনে হয়, মা ওই রকমই মহৎ আর সুন্দর হতে পারতো, তার প্রতি ওপর-অলার দাক্ষিণ্যের প্রসাদ আছে। কিন্তু মা তা হয় নি।