কিন্তু এ-দেশের ছবির গল্পে অক্ষত কুমারীকন্যার চাহিদা যতো, তত আর কিছু নয়। ছবিতে প্রেমের কাহিনী রূপায়ণ একমাত্র বাণিজ্যিক বস্তু। সেই প্রেম কোনো বিধবার অথবা কোনো বিবাহিতা রমণীর (স্বামী-প্রেম নয়) হলে সেটা পরিত্যাজ্য। টাকা ঢেলে কোনো প্রযোজক ছবিতে সেই জটিল প্রেম সচল করার ঝুঁকি নেবে না। ছবির প্রেম নিতান্তই বিশুদ্ধ নিকষিত হেম হওয়া চাই!
ফলে যত নামজাদা অভিনেত্রীই হোক, ছবির বাজারে বিপাশা দেবীর চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসছিল। কিন্তু শুধু সেই কারণেই কি মঞ্চের দিকে ঝুঁকেছে সে? আমার মনে হয় না। কারণ এই আকর্ষণের পিছনে আর্থিক অপ্রাচুর্য অথবা মোহ কিছু থাকার নয়। একটানা দশ বছর ছবির বাজারে সব থেকে চড়া দামের শিল্পী ছিল সে। শুনেছি, ওই কটা বছর ছবি পিছু খুব কম করে এক লক্ষ টাকা দেবার ক্ষমতা না থাকলে কোনো প্রযোজক তার দিকে এগোতেও সাহস করত না। মহিলার সঞ্চয়ের পরিমাণ নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি, তবু ধারণা, ফেলে ছড়িয়ে পঁচিশ তিরিশ লক্ষ টাকার কম হবে না। এছাড়া নিজের বাড়ি-গাড়ি-সোনা-গয়না তো আছেই।
না টাকাটা বোধহয় কোনদিনই তার অভিনয়-জীবনের একমাত্র কাম্য বস্তু ছিল না। এ-দেশের ছবির রাজ্যে ওই শিল্পীর মাথায় যখন অনন্যার মুকুট ঝলমল করছে, বোম্বাই বা মাদ্রাজের ধনকুবের হিন্দী ছবির প্রযোজকরা তখন তার কাছে হামেশাই ছুটে এসেছে। সে-খবর কাগজে আর সিনেমার মাসিক সাপ্তাহিকে ছাপা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্তও কোনো হিন্দী ছবির চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার খবর বেরোয় নি। যে স্বাক্ষরের রূপালি মূল্য বাংলা ছবির পাঁচ-সাত গুণ বেশি।
আর সেই সূত্রে সিনেমার মাসিক সাপ্তাহিকগুলোতে শিল্পীর মাথায় যে কতভাবে স্তুতি আর প্রশংসা বর্ষণ করা হয়েছে, ঠিক নেই। অত্যুৎসাহী গুণমুগ্ধ চিত্র সাক্ষাৎকারের বিবরণও ফলাও করে ছাপা হয়েছে।
প্রশ্ন, হিন্দী ছবিওয়ালারা এভাবে ডাকাডাকি করছে, আপনি যাচ্ছেন না কেন?
হিন্দী জানি নে।
সেটা কোনো সমস্যাই নয়, কত আর্টিস্ট তো দিব্যি শিখে-পড়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে।
জবাব, তারা আমার থেকে ঢের বড় গুণী হবেন।
চিত্র সাংবাদিক (সহাস্যে) : এটা যে ঠিক বললেন না, এও আপনি নিশ্চয় জানেন?
জবাব (সহাস্যে) : নিশ্চয় জানি না। তবে মনে হয়, শিখে পড়ে ফুলের ওপর রচনা লেখা যায়, ফুল ফোঁটানো যায় না।
মুগ্ধ চিত্র সাংবাদিক : তাহলে এটা ধরে নিতে পারি, শিল্পী-জীবনে টাকাটা আপনার আদৌ বড় লক্ষ্য নয়, আপনার শিল্প প্রতিভা কোনরকম জোড়াতাপ্লির সঙ্গে আপোসে নারাজ?
স্মিত জবাব : ধরে নিয়ে ও-কথা কাগজে লিখে দিলে বেশ বাহবা পাব। কিন্তু আসলে সেটা ডাহা মিথ্যে–নতুন কোনো পরীক্ষার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই না ভয়ে।
চিত্র সাংবাদিক (সবিস্ময়ে) : এত দিনের এত অভিজ্ঞতার পরেও আপনার ভয়! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা!
বিশ্বাস না করলে আমার সুবিধে। (এই জবাবে মিষ্টি হাসির আধিক্য ছিলই মনে হয়)।
চিত্র সাংবাদিক (নাছোড়বান্দা তবু) : কিন্তু ভয় কেন?
সরল সুললিত জবাব : আসলে তো আমি খুব একটা সাধারণ মেয়ে। প্রতিভার চটকদার বোঝা যত আপনারা মাথায় চাপাচ্ছেন ভিতরে ভিতরে ততো ভয়। তবু আপনাদের দেওয়া ওই সার্টিফিকেটের প্রতি লোভ তো আমার আছেই, তাই মনে। হয়, নতুন কিছুর মধ্যে গিয়ে ধরা পড়ে মরি কেন!
জবাব শুনে শুধু কি ওই চিত্র সাংবাদিক মুগ্ধ হয়েছিল? না, পড়ে আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম। আগে কত শত সহস্র জন মুগ্ধ হয়েছিল, ঠিক নেই। বিপাশা দেবী, তোমার অস্তিত্ব থেকে মা ইন্দুমতাঁকে সরাতে পারলে আমিও যে তোমার কত বড় এক ভক্ত, জানো না। মানুষকে মুগ্ধ করার সহজাত কৌশল তোমার স্বভাবের সঙ্গে মিশে আছে। তাই ভাবতে অবাক লাগে, এ কৌশল তুমি একজনের ওপর খাটালে না কেন, খাটাতে পারলে না কেন? খাটাতে পারলে না, না কি খাটাতে চাইলে না? সেই জন্যেই লোককে মুগ্ধ করার তোমার এই সহজ কৌশলই আমার অভিনয় মনে হয়।
কোনো বোঝাপড়া হবে, হবেই, সেইদিন আমি বুঝে নেব, তুমি শিল্পী বড় কি অভিনেত্রী বড়। ঠিক এই গোছের কথা শুনে শোভা গাঙ্গুলি একদিন বড় অবাক হয়েছিল, মনে আছে। বলেছিল, শিল্পী কি অভিনেত্রী নয়, না কি অভিনেত্রী শিল্পী নয়, দুইয়ে তফাত কি?
জবাব দেব কি, এই গাছের বোকা বোকা প্রশ্নের জবাব হয় না, আপনা থেকে না বুঝলে বোঝানো যায়! নিজের বুকে একটা আঙুলের টোকা মেরে বলেছিলাম, এইখানটায় একটু তফাত আছে।
তফাত বোঝার আগ্রহে শোভা গাঙ্গুলি একটা স্থূল জাল ফেলতে চেষ্টা করেছিল আমার চোখের সামনে। টেবিলে দুই কনুই ভর দিয়ে দুহাতের চেটোয় দুই গাল রেখে আমার দিকে একটু ঝুঁকে বসে বেশ নিবিষ্ট মাধুর্যে কথা কইছিল আর কথা শুনছিল। এবারে বাঁ হাতটা গাল থেকে নামিয়ে চাপার কলির মতো মধ্যমা বার দুই-তিন নিজের বুকে ঠুকে আবার জিজ্ঞাসা করেছিল, অভিনেত্রীদের কি এই জায়গাটা নেই।
বেচারী শোভা গাঙ্গুলি। আমার হাসি পেয়েছিল অবশ্য, কিন্তু চাউনিটা বোধহয় খরখরে হয়ে উঠেছিল। বলেছিলাম, আমার মা হলে কি করত জানো? গাল থেকে হাত দুটো নামিয়ে একটু নড়েচড়ে বসার ফাঁকে শাড়ির আঁচলটা আর একটু ভালো করে টেনেটুনে দিত তারপর সাদামাটা হোমিওপ্যাথিক বিস্ময়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকত খানিক, তারপর চোখের পাতা দুটো শুধু একবার নীচের দিকে নামিয়ে ঠিক তোমার মতো করেই জিজ্ঞাসা করত, অভিনেত্রীদের কি ও-জায়গাটা নেই?