চেষ্টা করো, কিছু না পারো আশ্বাস দাও, তাছাড়া হবে না-ই বা কেন, ওই মিতা বোস অন্তত ভালই পারবে মনে হয়–
চাপা বিরক্তিতে মা ঝাঁঝিয়ে উঠল, আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না, এবারে এলে স্পষ্ট বলে দেব।
বলে দেখো তো…!
বললে তুই কি করবি, শুনি?
ধীরে-সুস্থে জবাব দিলাম, কিছু একটা করব নিশ্চয়, কি করব সেটা পরের বিবেচনা…কালই মিতা বোসকে নিয়ে আসছি আমি, বলে দিও।
আমার বলার মধ্যে এমন কিছু ঠাণ্ডা হুমকি ছিল যে মা শুধু মুখের দিকে চেয়েছিল চুপচাপ। পরদিন মিতা বোস আসতে মা তাকে ফটো সমেত স্টুডিও-তে। দেখা করতে বলেছে। দুই-একজন প্রডিউসার আর ডাইরেক্টরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে।
আনন্দে মিতা বোস হাওয়ায় ভেসেছে। ট্যাক্সিতে আমার পাশে ঘন হয়ে বসেছে। অসঙ্কোচে আমার এক হাত ওর কাঁধে উঠে এসেছে। এই গোছের প্রশ্রয় ও আগেই দিয়েছে। আজ দাবি বাড়ালেও আপত্তি করবে না, জানি।
রাত সাড়ে নটার পর ওকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আমি ফিরেছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে কেমন। নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ধাক্কা খেয়েছি একটা। আমার ঠোঁটে দগদগে লিপস্টিকের দাগ। হঠাৎ বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় গা-টা ঘুলিয়ে উঠল কেমন। ওটা যেন রক্তের দাগ।
আশ্চর্য, এরপর শোভা গাঙ্গুলিকে নিয়ে বরং বেড়াবার ঝোঁকটা বেড়েছে আমার। ও বড় জোর মুখে একটু পাউডার বুলোয়। ওর গায়ে-কাঁধে হাত দিলে কেমন শক্ত হয়ে ওঠে। নার্ভাস হয়। আমার তাই ভালো লাগে। ওকেও মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছি, ফোটো সমেত মায়ের সঙ্গে স্টুডিও-তে দেখা করো, মা চুপ। আর শোভা কেমন যেন অসহায় বোধ করেছে। ফেরার সময় ট্যাক্সিতে গা ঘেঁষে বসে নি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, স্টুডিও-তে গেলে আপনি সঙ্গে থাকবেন না?
আমার হাসি পেয়েছে, আবার ভাল লেগেছে। মিতা আমাকে তুমি করে বলে, নাম ধরে ডাকে। কিন্তু এ-মেয়েটা অন্যরকম। তা বলে দুজনের কারো ওপরই মায়া মমতা নেই আমার। ফিল্ম-আর্টিস্ট হতে চায় বলেই যেন আমার খেসারত আদায়ের অধিকার। আকর্ষণটা মিতা বোসের থেকে আপাতত শোভা গাঙ্গুলির প্রতি বেশি বলেই ওর ওপর মমতা আরো কম।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এক নিরিবিলি কোণে বসে দুহাত বাড়িয়ে ওকে সজোরে কাছে টেনে আনতে ও ধরফড় করে উঠল একেবারে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, না না, না না
জোরে করেই দূরে বসল তারপর। ভয়ে শুকনো মুখ, কাঁপছেও মনে হল। আমার রাগ হয়ে গেল হঠাৎ, সশ্লেষে বলে উঠলাম, এত ভয় নিয়ে তুমি ফিল্ম-আর্টিস্ট হবার স্বপ্ন দেখো।
শোভা চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আশাহতের মতো বলল আমাকে দিয়ে সত্যিই কিছু হবে না, সুমনদা…আমি নিজেই তা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি কি করব, ব্যবসা অচল হতে বাবার অত অসুখ…ছোট ভাইগুলো না খেয়ে মুখ শুকিয়ে ঘোরে, মাত্র হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ, কে চাকরি দেবে আমাকে–মনাদা আপনার কথা। বলে ফিল্মলাইনের লোভ দেখালো, কিন্তু আপনার মায়ের সামনে গেলে পর্যন্ত আমার পা দুটো ঠকঠক করে কঁপে, পারব না, নিজেই বুঝতে পারি… পরে আবার মনে। হয়, না পারলে সবাইকে তো উপোস করে মরতে হবে।
মেয়েটা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি নির্বাক, হতভম্ব। আমার ভিতরের শয়তানটার গালে কে যেন ঠাস ঠাস করে দুটো চড় কষিয়ে দিল।
কি ভেবে আবার ওকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে চললাম।
অন্ধকার গলির মধ্যে সাতসেঁতে জীর্ণ বাড়ি একটা। ঘরে হারিকেন জ্বলছে, টাকা দিতে না পারার দরুন ইলেকট্রিক বন্ধ বোধ হয়। দারিদ্র্যের এই দশা আমি কল্পনা করতে পারি না। শোভার আমাকে ভিতরে ঢোকাবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ঢুকে পড়লাম যখন কি আর করবে। প্রথমে মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, মনাদার বন্ধু, এঁরই মায়ের মারফত চাকরির চেষ্টা হচ্ছে
শীর্ণমূর্তি মহিলা। ময়লা লালপেড়ে শাড়ি পরনে। গায়ে জামা নেই বলে এটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। তার কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুরের মস্ত টিপ একটা, সিথিতেও চওড়া করে সিঁদুর টানা। মুখের দিকে তাকালে ওই দুটো বস্তুই আগে চোখে পড়ে। আমার অন্তত পড়ছে। পাঁচ-ছটা রোগা রোগা ছেলে মেয়ে ঘরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাকে। ওরা শোভার নিজের আর খুড়তুতো ভাই-বোন।
শোভার কাকা রোজগারের ধান্ধায় বেবিয়েছে। ওর বাবাকে দেখলাম। শয্যাশায়ী লালচে মুখ, লালচে দেহ। শুনলাম ড্রাই ওয়াশিং-এর ব্যবসা ছিল। ফেল পড়ার পর। থেকে ব্লাডপ্রেসারে শয্যাশায়ী। ব্যবসা ফেল পড়ার কারণ, দোকানে ছোটখাট ডাকাতি হয়ে যায় হঠাৎ। পাঁচ-ছহাজার টাকার মাল চুরি হবার ফলে এই হাল। খদ্দেররা গলায় গামছা দিয়ে মালের দাম আদায় করে নিয়ে গেছে। পাঁচ বছরের লিজ ছিল বলেই দোকানঘরটাই শুধু তালাবন্ধ আছে এখনো। আঘাত পেয়ে ভদ্রলোকের মাথায় গণ্ডগোল। দেখা দিয়েছে একটু, হাজার সাতেক টাকা হাতে পেলে ব্যবসা এবারে কিভাবে চালু করা যেতে পারে, সেই হিসেব কষে, ভাইয়ের সঙ্গে সেই পরামর্শ আগের থেকেই সেরে রাখতে চায়। কিন্তু আর সকলে জানে, সাত-আট হাজার টাকা আকাশকুসুম। স্বপ্ন তাদের কাছে। ভদ্রলোক আমার দুহাত ধরে কাকুতি মিনতি করে বলল, দেখো না বাবা, কেউ যদি দেয় টাকাটা। আমি তাকে অর্ধেক অংশ লেখাপড়া করে দেব, বাকি অর্ধেক আমাদের দু ভাইয়ের থাকবে, তাকে কিছু করতে হবে না, সে শুধু ঘরে বসে লাভের অংশ পাবে।