সুটকেস হাতে করে নেমে এসে গাড়িতে চেপে বসলাম।-হাওড়া স্টেশন!
কোথায় কতদূরে চলেছি, আমিও জানি না। টেলিফোন পাবার পর আমার অভিনেত্রী মায়ের মুখখানা কি রকম হবে দেখতে সেটাই কল্পনা করতে ভালো লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে অকারণে যশোদার ওপর রাগ হতে থাকল।…মায়ের যন্ত্রণার ওপর প্রলেপ দেবার জন্য একজন কেউ আছে মায়ের কাছে। ছেলে খুইয়ে মা মেয়ে পেয়েছে। মনে হয়!
.
ফিরলাম প্রায় মাস দুই বাদে। বি-এ পরীক্ষা তার ঢের আগে চুকেবুকে গেছে। মায়ের। বাসনায় বাদ সাধতে পারার আনন্দ কতদিন আর জিইয়ে রাখা যায়? আবার যেন দ্বিগুণ অবসাদের সমুদ্র।
ফিরে এসে মায়ের গম্ভীর মুখখানা দেখে অবশ্য তুষ্টিলাভ করেছিলাম। কোথায় গেছলাম, কেন গেছলাম, মা একটা কথাও জিজ্ঞাসা করল না। গাম্ভীর্যের আড়ালে তার হতাশাটুকুও অগোচর থাকল না আমার। শুধু জিজ্ঞাসা করল, পড়াশুনা এখানেই শেষ তাহলে?
হ্যাঁ, আর ভালো লাগে না।
আর আড়ালে অনুযোগের সুরে যশোদা বলল, আপনার মাথার ঠিক নেই, কি কাণ্ড যে করেন এক-একসময়…মাকে এভাবে দুঃখ দেন কেন?
কি?
গলার স্বর শুনেই যশোদা ঘাবড়ে গেল। আর কিছু বলল না।
একভাবে দিন চলছিল। বছরখানেক বাদে আবার একটু বৈচিত্র্যের স্বাদ পেলাম যেন। দুটি মেয়ের পদার্পণ ঘটেছে আমার জীবনে। তাদের একজন মিতা বোস আর একজন শোভা গাঙ্গুলি। দুজনেরই বছর কুড়ি হবে বয়স। তার মধ্যে। মিতা বোস দস্তুরমতো সুশ্রী। চেহারায় আর সাজ-পোশাকে স্মার্টনেসের চটক আছে। ইউ, পি-তে তার দাদুর কাছে থেকে বি-এ পড়ত। ফেল করে কলকাতায় বাপের বাড়ি চলে এসেছে। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে তিনখানা বাড়ির পর ওদের বাড়ি। মিতা বোসের বাবা মার্চেন্ট আপিসের বড় চাকুরে আর মা দস্তুরমতো আধুনিকা। ৫৫৬
শোভা গাঙ্গুলির চেহারায় বা চাল-চলনে মিতা বোসের মতো চমক নেই বটে, কিন্তু ওই মেয়েটাও বেশ সুশ্রী। ওদের বাড়ি-ঘর আমি দেখি নি, মাইল দুই-তিন দূরে, শুনেছি। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর আর পড়াশুনার সুযোগ হয় নি। বাড়ির অবস্থা তেমন সুবিধের নয় বোধহয়, কিন্তু সাদামাটা বেশবাসে ওই মেয়েটাও মিতা বোসের থেকে খারাপ লাগে না আমার।
শোভা গাঙ্গুলি জিতেন পোদ্দারের দলের নতুন রিক্রুট–মনা গাঙ্গুলির খুড়তুতো বোন। মনা গাঙ্গুলি জিতুর পরের দিকের সেই সাধারণ স্কুলের সহপাঠী ছিল।
বেশ চৌকস ছেলে, আই-এস-সি পাশ করার পর কোন ফার্মে টেকনিসিয়ানের ট্রেনিং-এ ছিল কিছুকাল। সেই ফার্ম লক আউট হয়ে যাবার ফলে বাপ-কাকার ব্যবসায় ঢুকেছিল। সেটাও ফেল পড়তে আর চাকরি-বাকরি না জোটার ফলে জিতু পোদ্দারের দলে ভিড়ে গিয়ে এখন বহাল তবিয়েতে আছে।
মায়ের সুপারিশে খুড়তুতো বোন শোভা গাঙ্গুলিকে সিনেমায় ঢুকিয়ে দেবার জন্য মনা গাঙ্গুলি আমার পিছনে লেগে আছে। জিতু পোদ্দারও আমাকে ওর হয়ে অনুরোধ করেছে।
আর ঠিক ওই বাসনা নিয়েই আপ-টু-ডেট মেয়ে মিতা বোস নিজে এসে আলাপটা এখন একটু ভাবের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে।
জিতু পোদ্দার আর মনা গাঙ্গুলি শোভাকেও একদিন আমাদের বাড়ি নিয়ে এলো। আর তাকেও মন্দ লাগল না আমার। কথা দিলাম, চেষ্টা করব, তবে লেগে থাকতে
মিতাকেও একই কথা বলেছিলাম। লেগে থাকার অর্থটা ওরা ঠিকই বুঝে নিয়েছে। মিতার বাড়ি এক মিনিটের পথ, সে সপ্তাহের মধ্যে চার পাঁচদিন আসে। দূরে থাকে বলে শোভা অত ঘন ঘন আসতে পারে না, তবু সপ্তাহে দিন দুই অন্তত এসে ঘণ্টাখানেক ধরে বসে গল্প করে চা খেয়ে যায়।
এই দুই মেয়ের আনাগোনা দেখে নতুন মায়ের চক্ষুস্থির। তা দেখেও মজা লাগে আমার। মায়ের কাছে নতুন মায়ের টেলিফোনে খবর জানানো সারা। মা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তোর কাছে নাকি দুটো মেয়ে খুব যাওয়া আসা করছে আজকাল?
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ফিরে জিজ্ঞাসা করি, কেন, তোমার আপত্তি আছে?
আপত্তি করলে কি ফল হবে মায়ের জানা হয়ে গেছে। জবাব দিয়েছে, না, আমি তোর কে, যে আপত্তি হবে…।
হেসে বললাম, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আসা যাওয়া করছে তারা, শীগগিরই টের পাবে।
টের পেয়েছে, একে একে দুজনকেই নিয়ে মায়ের কাছে এসেছি। মায়ের সামনে ভক্তি-শ্রদ্ধায় অবনত দুজনেই। মিতা বোস তো পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বসল। আমার মার্জিতরুচি অভিনেত্রী মা-দুজনের সঙ্গেই সদয় ব্যবহার করেছে, যত্ন করেছে, কিন্তু কাজের বেলায় গম্ভীর মুখে বলেছে, বড় শক্ত, দেখি কি করতে পারি।
মিতা বোস বলেছে, আপনার স্নেহ পেলে আর কিছু চাই না, সব সহজ হয়ে যাবে।
শোভা গাঙ্গুলি কিছু বলে নি। দু চোখে শুধু আশা জমাট বেঁধেছে।
পরে মা ধমকের সুরে বলেছে, এ-সব কি আরম্ভ করেছিস তুই, আমি কারো জন্যে কিছু করতে পারব না।
আমি নির্লিপ্ত চেষ্টা করে দেখো না, কালে-দিনে তোমার থেকেও বড় আর্টিস্ট হতে পারে ওরা।
একদিন নয়, শোভা গাঙ্গুলিকে পরের ছমাসের মধ্যে দিন চারেক আর মিতা। বোসকে দিন দশেক মায়ের কাছে এনেছি। পরের জনকে মায়ের সামনেই উসকে দিয়েছি, ঠিক মত হামলা করতে পারছ না, হবে কি করে! হামলায় সাহায্য করার জন্য ওকে নিয়ে স্টুডিওতেও এসেছি।
ভিতরে ভিতরে মা ভয়ানক বিরক্ত। একলা পেয়ে ধমকে উঠেছে, আমি কিছু করতে পারব না, বলেছি না?