অনার্স ছাড়ব-ছাড়ব করেও ছাড়ি নি। তাই মন দিয়েই পড়াশুনা করছিলাম বটে। দিনকতক। কিছুই ভালো লাগে না বটে, কিন্তু অযোগ্যতার ছাপ কপালে পড়বে সেটা তেমন বাঞ্ছিত নয়। বরং পাশ করে ডিগ্রীর ছাড়পত্র অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলে দিতে পারি।
হঠাৎ মনে হল, মা-কে অনেকদিন দেখিনি। না দেখা মানেই তার দিনরাতের চিন্তার থেকে নিজেকে অনুপস্থিত রাখা। এই স্বস্তিটুকু তাকে দিতে আমার বিশেষ আপত্তি।
গিয়ে দেখি, মা নেই, যশোদাও নেই। আয়া জানালো, দুজনে বেরিয়েছে একটু, খানিকক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। আমাকে বসিয়ে চা-কফি খাওয়াবার জন্য সে রীতিমতো তোয়াজ তোষামোদ শুরু করে দিল। অর্থাৎ আমি এসেও ফিরে গেছি শুনলে মায়ের ওর ওপরে বিরূপ হবার সম্ভাবনা।
খানিকক্ষণের মধ্যেই ফিরল বটে দুজনে। যশোদা বেশ সাজগোজ করে বেরিয়েছিল, মায়ের সাজটা বরাবরই চাপা গোছের। যশোদা গোটাকতক শাড়ির বাক্স বুকে করে ঘরে ঢুকল। পিছনে মা।
ও মা, আপনি কতক্ষণ!
জবাব না দিয়ে ওকে দেখলাম একটু ভালো করে। বেশ সুন্দরই দেখাচ্ছে। মা আড়চোখে আমার দেখাটা লক্ষ্য করল। সেজন্যে আমার সঙ্কোচের লেশ মাত্র নেই। যশোদা দস্তুর মতো মহিলা গোছের হয়ে উঠেছে।
কোথায় গেছলে?
মা নিয়ে মার্কেটে বেরুলো। খুব সুন্দর সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছে, দেখবেন?
আমি হাসলাম একটু। বললাম, তুমি ভাগ্যবতী দেখছি।
যশোদার দুচোখ আমার জামা-কাপড়ের ওপর থমকালো। পরনের জামা বা কাপড় ধোপদুরস্ত নয়, জামার কাঁধের কাছটা ছেঁড়াও একটু। পাশের সোফায় বসে মা-ও তাই লক্ষ্য করছিল। বলল, চল, আবার বেরোই একটু, গাড়িটা তোলা হয় নি এখনো
মায়ের দিকে ফিরলাম।-জামা-কাপড় কিনে দেবে?
মা জোর দিয়ে বলল, দেব তো, জামা-কাপড়ের এ কি ছিরি তোর, নেই কিছু?
ঢের আছে। সোফার কাঁধে মাথা রেখে আরো গা ছেড়ে বসলাম আমি।
তাগিদ দিয়ে ফল হবে না বুঝেই মা আর আমাকে তোলার চেষ্টা করল না। তক্ষণি আয়া ডিশভর্তি খাবার নিয়ে এলো। আমি এলে এটুকু বরাদ্দ, আয়া ভালো। করেই জানে। মা যশোদার দিকে তাকালো, তুই তো বিকেলে খাস নি কিছু এই সঙ্গে খেয়ে নে না?
যশোদা বলে উঠল, খেয়ে খেয়ে মুটিয়ে গেলাম, অত খা খা করো না তো!
ওর দিকে ফিরলাম আবার।…মেয়েটা আজ চোখ টানছে।দেখতে ভালো লাগছে।
মা প্রসঙ্গ ঘোরালো। খুব মন দিয়ে লেখা-পড়া করছিস, শুনলাম?
জবাব নিষ্প্রয়োজন। খাবারের ডিশ খালি করার দিকে মন দিয়েছি। বেশ খিদে পেয়েছিল।
মা আবার বলল, ভালো করে পাশ করলে তোকে আমি বাইরে পাঠিয়ে দেব, ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা–যেখানে তোর খুশি। সেখান থেকে ডিগ্রী-ফিগ্রী নিয়ে মস্ত মানুষ হয়ে ফিরবি, রাজি আছিস?
আমি মন দিয়ে পড়াশুনা করছি শুনেই মায়ের এত আনন্দ, এত আশা। উৎসুক আগ্রহে আমার দিকে চেয়ে জবাবের প্রতীক্ষা করছে। মূহুর্তের মধ্যে আমার মাথায় সেই পরিচিত উষ্ণ বায়বিক স্রোতটা ওঠানামা করতে লাগল। দরকার হলে আমিও এখন একটু আধটু অভিনয় করতে পারি। তার আগ্রহে ইন্ধন জুগিয়ে সাগ্রহে বললাম, সত্যি বলছ, ঠিক পাঠাবে? এতীম Sys
মা আরো খুশি–আমি তোকে মিথ্যে বলব নাকি? বলিস তো, তোকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে স্থিতি করে দিয়ে আসব।
যশোদা বলে উঠল, বা রে তাহলে আমি?
মনের আনন্দে মা তাকেও প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলল।-আচ্ছা, তোকেও নিয়ে যাবখন।
যশোদা হেসে উঠল, তাহলেই সুমনদার পড়া হয়েছে
মা বলল, কেন হবে না, আমরা কি ওর মতো দু-তিন বছর থাকতে যাচ্ছি, মাস দুই থেকে দেখে-শুনে বেড়িয়ে আবার চলে আসব।
এরপর বিদেশে যাওয়ার জটলাটা তিনজনের মধ্যে জমে উঠল বেশ। মা-কে প্রস্তুত থাকতে বললাম, কারণ আমার পরীক্ষা এসেই গেছে প্রায়, আর ভালো ফলও ইচ্ছে করলেই করতে পারি।
মায়ের গাড়ি নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। তার স্বস্তিভরা পরিতুষ্ট মুখখানা চোখে ভাসছে। মায়ের কি হয় জানি না, কিন্তু অভিনয় করতে গেলে আমার মাথার ভিতরে কেমন একটা দপদপানি শুরু হয়। আজ সেটা খুব বেশি হচ্ছে।
গাড়িটা দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ি ঢুকলাম। বাবা এতক্ষণে মদের গেলাস আর বোতল নিয়ে বসে গেছে। আমার নতুন মা-কে দরকার।
টাকা দাও তো কিছু।
এ-সময়ে টাকা চাইতে নতুন মা অবাক একটু।–কত?
তিন শ চার শ, যা পারো দাও।
হঠাৎ অত টাকা দিয়ে কি হবে?
দিনকতকের জন্য বাইরে যাব, দেরি করো না, শীগগির আনো।
নিজের ঘরে এসে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সুটকেসটা গুছিয়ে নিলাম। মাথার দপদপানি বাড়ছে। কত সময় মনে হয়েছে, নিজেকে ধ্বংস করে দিলে মায়ের মুখখানা। দেখতে কেমন হয়? এখনো সেই গোছেরই অনুভূতি।
টাকার জন্য এ-সময় নতুন মা বাবাকে বলবে না, জানা কথাই। কারণ মা যে আমার খরচের জন্য মাঝে মাঝে তার হাতে টাকা দেয় সে খবর রাখি। আমি নিজের হাতে কিছু নেব না জানে বলেই ওই করে। মা এখন নতুন মাকে আগের থেকেও বেশি অন্তরঙ্গজন ভাবে।
নতুন মা ঘরে এসে বলল, সত্যিই কি তুই যাবি নাকি? কোথায় যাবি, কি জন্যে যাবি?
আমি ধমকের স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা এনেছ?
থতমত খেয়ে নতুন মা তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিল। –তিনশ টাকা আছে। …কিন্তু কোথায় যাবি, কতদিনের জন্য চললি, বলবি তো?
গিয়ে চিঠি দেব। ভালো কথা, তুমি মাকে খানিক বাদে একটা ফোন করে দিও তো!