কিন্তু আমি বিচ্ছিন্ন সকলের কাছ থেকে। আমার খণ্ডিত সত্তা অশান্ত ক্ষোভে আজও ঠিক তেমনি করেই মাথা খুঁড়ে মরছে।
মা আবার একটা আলাদা বাড়ি করেছে। নিজস্ব বাড়ি। তার জীবনের তৃতীয় ভদ্রলোকটিকেও সরে যেতে হয়েছে। মা আমার বাবাকে বরদাস্ত করতে পারে নি, জানি। অপর দুজনকে পারল না কেন, জানা নেই। মায়ে নিজের একান্ত রুচিবোধের ওপর আমার শ্রদ্ধা আছে, মনে হয়, অন্য সকলের ক্ষেত্রে সেটাই শেষ পর্যন্ত অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই চল্লিশ বছর বয়সেও মায়ের অভিনয়জীবনের জৌলুসে টান ধরে নি, ওই জগতে এখনো অনন্যা সে। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তার আর কোনো আগন্তুক আসবে বলে মনে হয় না। নতুন বাড়ি করার পর আমাকে অনেকবার অনুরোধ করেছে, এখানে চলে আয় না, তোতে আমাতে থাকি।
একদিন আমি হাসি-মুখে জবাব দিয়েছিলাম, অনেক দেরি করে ফেলেছ মা, অনেক দেরীতে ডাকলে। তোমাকে একটা মরা ছেলের মা হিসেবে দেখতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
তারপর আর এই অনুরোধ করে নি।
গোটা তিনেক আয়া আর ঝি, আধ-বয়সী একটা চাকর, আর গেটে প্রহরারত একটা দরোয়ান নিয়ে মা তার নতুন বাড়িতে একলা থাকে এখন। না, একলা বলছি কেন, যশোদাও তো সেই থেকেই মায়ের সঙ্গে থাকে।
আমার সতের বছর বয়স থেকে মায়ের কাছে যশোদাকে দেখছি। ওর বছর, বারো বয়স তখন। ফ্রক পরত। কিন্তু বয়সের তুলনায় বাড়ন্ত গড়ন বলে পনের বছরে। পা দেবার আগেই শাড়ি ধরেছে। মাঝ বয়সে পরলোকগতা এক মাঝারি গোছের নামী অভিনেত্রীর মেয়ে যশোদা। মারা যাবার আগে মেয়েকে মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে যায়। সেই থেকে মায়ের কাছেই আছে। বাড়িতে দুজন মাষ্টার রেখে মা ওকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। আবার কয়েকটা ছবিতে ওকে ছোটখাট পার্ট করতেও দেখা গেছে। অনেকের ধারণা মায়ের কাছে আছে যখন, কালে-দিনে আর্টিস্ট হবে।
যশোদা মায়ের প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছে, সে-ও আমার চক্ষুশূল। মেয়েটা গোড়া থেকেই তা বুঝতে পারতো বোধ হয়। তাই আমাকে একটু ভয়ের চোখে দেখত। মায়ের সঙ্গে আমার বেপরোয়া আচরণ আর কথাবার্তার ধরণ-ধারণ দেখে শুনেও দস্তুর মতো সমীহ করত। আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেই ছুটে গিয়ে মাকে খবর দেয়, তারপর মায়ের পাশ ঘেঁষে বসে বড় বড় চোখ মেলে আমাকে দেখে।
এখন অবশ্য ভয়ের ভাবটা কেটেছে। দেখলে হাসি-মুখে গল্প করতে চায়, যখন তখন মায়ের অশান্তির কারণ ঘটাই বলে মৃদুমন্দ অনুযোগও করে। আমার ধারণা, যদি আমি ওই যশোদার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাই, মা তাতেও আপত্তি করবে না, বরং খুশি চিত্তে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে তখন ছেলে-বউ দুজনকেই আগলে রাখবে।
আমাকে পাবার মায়ের এই নিভৃত আকাঙ্ক্ষা টের পেলেই আমার ভিতরটা যেন আরো হিংস্র আরো নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে চায়।
এদিক থেকে স্বভাব আমার ভিতরে ভিতরে ঢের বেশি উগ্র আর নির্দয় হয়ে উঠেছে, মা যা চায়, আমি তা চাই না। মা চায়, আমি লেখাপড়া শিখে মস্ত একজন হয়ে উঠি। সেই জন্যেই বোধহয় বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কম আমার, হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার পর মা সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেমন দিলি?
আমি নিস্পৃহ জবাব দিয়েছিলাম, ফেল করব, জানা কথাই তো।
আমারও তাই বাসনা ছিল। কিন্তু ফল বেরুতে দেখা গেল, ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছি। আর তারপর মায়ের আনন্দ দেখে ভিতরে ভিতরে রাগে জ্বলেছি। লিখতে বসে পরীক্ষার খাতায় কেন হিজিবিজি কেটে এলাম না, সেই অনুশোচনা হয়েছে।
মায়ের বরাবর ভয়-পাছে অসৎ সঙ্গে মিশি। ফলে ওই অসৎ সঙ্গ-ই একমাত্র আশ্রয় যেন আমার। সেই জিতু পোদ্দার আর তার দলবল অন্তরঙ্গ-সাথী এখন। জিতু পোদ্দার আগের থেকেও অনেক দুরন্ত, অনেক দুঃসাহসী হয়েছে। দলবল নিয়ে হামলা করে নানা ভাবে টাকা রোজগার করা শুরু করেছে। ওরা দেখেছে, দুচারটে বোমাপটকা, ছোরা-ছুরিতে বেশ কাজ হয়। স্রেফ হুমকি দিয়ে বা উড়ো চিঠি ছেড়েও অনেক সময় পকেটে ভালো টাকা আসে। ফলে ওদের সাহস বেড়েই চলেছে। আমি ওদের সঙ্গে মিশি শুধু উত্তেজনার লোভে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চ আছে। ওদের হাতে কারো নিগ্রহ বা নির্যাতন দেখলে কষ্ট হয় না, এমন নয়। আমি সামনে থাকলে, পায়ে-হাঁটা পথের মানুষদের ওপর ওকে হামলা করতে দেখলে বাধা দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু সুখের জোয়ারে ভাসছে এমন বাড়ি-গাড়ি-ওয়ালাদের হেনস্থা। কেন যেন বেশ উপভোগ্য লাগে। অবশ্য ওদের টাকা রোজগারের কোনো পরিকল্পনার বা অভিযানের সঙ্গে আমার কোনরকম প্রত্যক্ষ যোগ নেই। আমাকে ভাগ দিতে হয় না বলে জিতু পোদ্দারের দল খুশি বই অখুশি নয়। আমার শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দ্রষ্টার ভূমিকা। কখনো-সখনো দুই একটা প্ল্যান বাতলে দিই, এই পর্যন্ত।
ওরা অন্তরঙ্গ ভাবে বটে, কিন্তু আসলে ওদের থেকেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আমি। আমার আনন্দের দোসর নেই, ব্যথারও ভাগীদার নেই। এক একলার জগতে আমি নির্বাসিত। সেখানে টিপটিপ করে জ্বলছি আর নিভছি।
বি-এ ফাইন্যাল পরীক্ষার দিনকতক আগের এক সন্ধ্যায় মায়ের কাছে এলাম। মাঝে অনেক দিন আসি নি। মা টেলিফোনে নতুন মায়ের কাছে শুনেছে, বেশ মন দিয়ে পড়শুনা শুরু করেছি। তাই আর আমাকে ডাকাডাকি করে বিরক্ত করে নি। আর আমার মতিগতি ফিরল বলে মনে মনে হয়তো খুশিও হয়েছে।