কার সঙ্গে এলি, একলা নাকি?
মাথা নাড়লাম, তাই।
বাসে এলি?
ট্রামে।
একা এভাবে ট্রামে-বাসে আসবি না, যখন আসতে ইচ্ছে হবে, ফোন করে দিবি, গাড়ি যাবে। আর এরকম হঠাৎ আসতে ইচ্ছে হলে ট্যাক্সি নিবি।
ট্যাক্সির পয়সা পাব কোথায়?
মা থমকালো একটু। মালতী মাসি নেই, নতুন করে মনে পড়ল বোধহয়। বলল, বাজে খরচ করবি না কথা দিলে তোর হাতে আমি কিছু টাকা দিয়ে রাখতে পারি।
ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম, তোমার টাকা নিতে যাচ্ছে কে!
রাগত মুখে মা বলল, বেইমান কোহকারের!
এতকাল ধরে যে মাসির মারফত আমার সব খরচ সে-ই চালিয়ে আসছিল, সেকথা মুখে বললে না। একটু বাদে জিজ্ঞাসা করল, বাড়ির খবর কি?
ভালই তো।
নতুন মা কেমন?
খুব চমৎকার। হঠাৎ দশগুণ বাড়িয়ে বলার ঝোঁক চাপল কেন, জানি না। আর পরীর মতো দেখতে একেবারে।
আমার ধারণা–নতুন মায়ের সঙ্গে কোনকালেও দেখা হবে না। এই নির্জলা উচ্ছ্বাসের মধ্যেও মায়ের চোখে যেন কিছু গলদ ধরা পড়ল। সন্দিগ্ধ সুরে জিজ্ঞাসা করল, চমৎকার বুঝলি কি করে, তোকে আদর যত্ন করে?
করতে আসে। আমি পাত্তা দিই না।
মা আবার খানিক চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, মাসি নেই, সময়মতো চান। খাওয়া-দাওয়া সব করিস তো?
জবাব দেওয়ার দরকার বোধ করলাম না। মাসি না থাকার ক্ষতটা বুকের তলায়। এখনো দগদগ করছে।
একটু ভেবে মা বলল, তোকে যদি খুব ভালো কোনো হস্টেলে রেখে দিই, থাকবি?
কেন?
কেন আবার কি, ভালো হয়ে থাকবি, পড়াশুনা করবি!
আমাকে হস্টেলে রেখে বাবাকে ওই বড় থেকে তাড়াবে?
মা সত্যিই অবাক।–তাড়াব কেন?
তাহলে বাড়ি আমার নামে দানপত্র করলে? বাবা এমন কি দোষ করেছে, তাকে ছেড়ে এসে তুমি দু-দবার বিয়ে করলে, বাবা তো শুধু একবার করেছে
মনে হল, মা এই বুঝি আমার গালে ঠস করে চড় বসিয়ে দিল একটা। তা করল না, ঠাণ্ডা চোখ দুটো আমার মুখের ওপর চক্কর খেল এক প্রস্থ। তার তের বছরের ছেলে অকালে কত পেকেছে, তাই যেন নতুন করে অনুভব করল। তারপর গম্ভর মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
একটু বাদে আবার ফিরবে জানি। ঝি বা চাকরের হাতে থালা ভর্তি খাবার থাকবে। আমি সামনে বসে খেলে মা খুশি হয়, নির্নিমেষে দেখে চেয়ে চেয়ে।
আজ সে-সুযোগ দিলাম না। উঠে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম গেট পার হয়ে, ফিরে তাকালাম একবার। ঠিকই অনুমান করেছি, বারান্দার রেলিং-এ দাঁড়িয়ে–আমার দিকেই চেয়ে আছে। গম্ভীর কিন্তু অসহায় মুখ। ভেবেছিলাম, ডাকবে।
ডাকল না।
***
ঘৃণা, বিদ্বেষ বা প্রতিশোধের নেশা আসলে বোধ হয় নিজেরই অগোচরের উন্মাদ দশা কিছু। নইলে বুকের তলায় ওই আগুন জ্বেলে বসলে সর্বক্ষণ নিজেকেই দগ্ধায় কেন? প্রতিহিংসার অন্তদৃষ্টি নেই! নখদন্ত মেলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ার ছল খোঁজে আর তারপর অন্ধ আক্রোশে নিজেকেই ছিন্নভিন্ন করে। তোমার ঘৃণা, তোমার বিদ্বেষ, তোমার হিংসার শিকার তুমি নিজেই।
এখন বয়স আমার একুশ। চোদ্দ বছর ধরে বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতই একটা আত্মহননের অমোঘ নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে, সেটা মাঝে মাঝে অনুভব করলেও তার থেকে অব্যাহতি নেই।
বাইরে আমি ঠিক তেমনিই আছি, কিন্তু ভিতরটা আরো অনেক গুণ উগ্র আর অশান্ত। একই বাড়িতে বাবা আর আমি দুটি বিভিন্ন প্রবাসী প্রাণী বাস করছি যেন। সামনাসামনি পড়ে গেলেও একজন আর একজনের পাশ কাটিয়ে চলা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আরো চার-পাঁচ বছর আগে থেকেই বাবা অনুভব করেছে, আমি তার শাসনের আওতার বাইরে চলে গেছি। আর আমার দিক থেকে বাবার সঙ্গে সম্পর্ক শুধু টাকার। সঙ্গী-সাথীর কল্যাণে টাকার চাহিদা আমার কম নয়। নিঃশব্দে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে টাকার জোরটা একটা বড় জোর। দরকার হলেই নতুন মাকে জানিয়ে দিই; অত টাকা চাই। নতুন মা ভিতরে ভিতরে শঙ্কা বোধ করলেও মুখে কিছু বলে না। এনে দেয়। টাকা দিতে বাবার অসুবিধে হবার কথা নয় কারণ তার ব্যবসা পুরোদমে চলছে। এখন নতুন মায়ের জন্যেও আলাদা একটা গাড়ি কিনে দিয়েছে। কিন্তু ছেলের হুকুম মতো বাবার টাকা বার করে দিতে একটু আপত্তি বোধ হয়। মা আমার জন্য টাকা চাইতে গেলে তার চাপা তর্জন গর্জন একটু আধটু কানে আসে। কিন্তু আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে না বা ঘাঁটায় না কখনো। টাকা দিয়ে দেয়। কারণ আমার টাকা চাওয়ার মধ্যে প্রচ্ছন্ন জোরের দিকটা বাবা অনুভব করে বোধ হয়।
নতুন মা আমার জীবনে কোনো সমস্যা নয়। আমার কাছে অনেকখানি নিষ্প্রভ অস্তিত্ব তার। নতুন মা আমাকে ভালবাসে কি না জানি না, কারণ ভালবাসার তেমন সুযোগ তাকে কখনো দিই নি। সে আমাকে সমীহ করে, আমি কার ছেলে, সেটা ভোলে না কখনো। এখনো আমার মায়ের মস্ত অনুরাগিণী ভক্ত এই নতুন মা-টি। সুযোগ সুবিধে পেলেই মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে, আর যেতে আসতে মায়ের পায়ে ঢিপ ঢিপ প্রণাম করে।…না, মালতী মাসিকে সরিয়ে সে এ-সংসারে এসেছে। বলে আমার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। সঙ্গতভাবে চিন্তা করলে বরং মায়া হবার কথা। …নিতান্ত গরিব ঘরের বি-এ পাশ মেয়ে, তার বাপ বাবার কারখানায় সাধারণ চাকরি করত একটা। বাবার শ্বশুর হয়ে বসার পর থেকে অবশ্য কিছুটা অসাধারণ হয়েছে। ঘোড়া-রোগ ছিল ভদ্রলোকের, মাইনের টাকার অর্ধেকের বেশি রেসের মাঠে যেত, ফলে ধার-দেনায় মাথা বিকিয়েছিল। তার স্ত্রী চিঠি লিখে বাবাকে অনুরোধ করেছিল, মাইনের টাকা যেন স্বামীর হাতে না দেওয়া হয়। মাস-কাবারে এই নতুন মাকে পাঠিয়ে দিত বাপের মাইনের টাকা আনতে। আমার বাবার সামনে বাপ সই করত আর মেয়ে টাকা নিত। মাত্র মাস কয়েকের ওই যোগাযোগের পরেই বাবা ওই মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসেছে। নতুন মায়ের বাপের বাড়ির মানুষেরা সেই জন্য আমার বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ। মনে হয়, অবস্থার দিক বিবেচনা করলে নতুন মা-ও অকৃতজ্ঞ নয়। কিন্তু কৃতজ্ঞতা আর প্রেমপ্রীতি ভিন্ন জিনিস। বাবাকে কোনো মেয়ের মনে ধরতে পারে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। আমার মায়ের প্রতি নতুন মায়ের আকর্ষণটা বরং ঢের খাঁটি মনে হয়। আর মাও তাকে কিছুটা স্নেহ আর বিশ্বাস করতে পেরে খুশি। কারণ, আজও তার দায় আমি। আমাকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। আমার ব্যাপারে মা আগে মালতী মাসির ওপর নির্ভর করত, এখন নির্ভর করছে নতুন মায়ের ওপর। নির্ভর আর বিশ্বাস করতে যে পেরেছে, এ-টুকুই নতুন মায়ের সত্যিকারের গুণ বলতে হবে। এদিকে তার সচলতা প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই।