কিন্তু এর মধ্যে বাবা একবারও মালতী মাসির খোঁজ করল না। বিয়ে করে বাবার কি এত আনন্দ হয়েছে যে মালতী মাসি বাড়ি নেই তা খেয়ালও করল না! এত বছর ধরে, মা যাবার আগের থেকেও এ-বাড়ির কর্তৃত্ব বলতে গেলে মালতী মাসির হাতে, সে বাড়ি নেই, বাবার চোখেও পড়ল না এতক্ষণে?
আমার মন বলছে, তা হতে পারে না। আমার মন বলছে, বাবা খুব ভালো করে জানে মাসি নেই, মাসি আর আসবে না। কি করে জানল?…তাহলে বাবাই কি তাড়িয়েছে মাসিকে? বিয়ে করতে যাবার আগে বলে গেছে, ফিরে এসে যেন এ বাড়িতে তোমাকে আর না দেখি?
সেটা সম্ভব কি অসম্ভব জানি না। আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। সামনের আবছা অন্ধকার বারান্দায় এসে পায়চারি করতে লাগলাম। বাবার ঘরের দোর পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসছি। উদ্দেশ্য, বাবার চোখে পড়ক।
পড়ল। ডাকল, সুমন এ-দিকে আয়
ঘরে ঢুকলাম। নতুন মা খাটের একদিকে বসে। আমার দিকে তাকালো কিন্তু কাছে ডাকতে সাহস করল না।
নতুন মায়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে তো? তোকে খুব ভালোবাসবে, দেখিস
সে কথায় কান না দিয়ে সোজা বাবার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, মালতী মাসি খুব ভোরে বাড়ি থেকে চলে গেছে, আর ফেরে নি ট্যাক্সিতে তার বাক্স আর বিছানাও নিয়ে গেছে।
নতুন মা ঈষৎ বিস্ময়ে বাবার দিকে তাকিয়েছে। বাবার মুখখানা দেখার মতো তখন। গম্ভীর কিন্তু ভিতরে-ভিতরে যেন ধড়ফড় করছে।
ঠিক আছে, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো গে।
বেরিয়ে এসে নিজের ঘরের সামনে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। মাথার মধ্যে তখনো কত আগুন জ্বলছে আমার, কেউ কল্পনা করতে পারবে না। একটু বাদে আবছা অন্ধকার বারান্দায় ছায়া পড়ল। নতুন মা পায়ে পায়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। অস্ফুট মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করল, মাসি চলে গেছে বলে তোমার খুব মন খারাপ বুঝি?
আমি জবাব দিলাম না। সুযোগের প্রতীক্ষায় আছি। বাবার সামনে যেটুকু বলে এসেছি, তা যেন কিছুই নয়। সকলের সুখ-শান্তি তছনছ করে দেবার মতো ভিতরটা গনগন করছে আমার।
তেমনি মৃদুস্বরে নতুন মা আবার জিজ্ঞাসা করল, মালতী মাসি কে? তোমার নিজের মাসি?
যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম সেটাই যেন এগিয়ে এসেছে। সাত বছরের বয়সে না বুঝে শুধু ক্ষোভের মুখে মা-কে যেকথা বলেছিলাম, তোরো বছর বয়সে নতুন মা-কে অনেকখানি বুঝেই সেই কথা বলে দিলাম!..তেরো বছর বয়সটা ও বড় করে দেখবে না, অবোধ ছেলেমানুষই ভাববে, কিন্তু ধাক্কাটা যেখানে লাগার ঠিক গিয়ে লাগবে।
না, মায়ের বন্ধু। আমার জন্মের আগে থেকে এ-বাড়িতে থাকত। মা চলে যাবার পর বাবার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল কিন্তু তুমি আসবে বলে এখন বাবাই বোধ হয় মাসিকে তাড়িয়েছে বাড়ি থেকে!
হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে কে আমাকে টেনে নিল পিছন থেকে। নতুন মা-ও চমকে ঘুরে দাঁড়াল। বাবা। ঘাড় ধরে আমাকে ঘরের মধ্যে এত জোরে ঠেলে দিল যে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম।
কিন্তু এ-অপমান গায়ে একটুও লাগল না আমার। সকাল থেকে আমার মাথার মধ্যে যে শয়তান দাপাদাপি করছিল, এতক্ষণে সে বুঝি একটু ঠাণ্ডা হয়েছে।
.
দিন তিনেকের মধ্যে আর এক ব্যাপারের সূত্রপাত। সে আমার কাছে এক উপভোগ্য প্রহসন। সকালে মস্ত ঝকঝকে গাড়ি হাঁকিয়ে এক অপরিচিত ভদ্রলোক বাড়িতে হাজির। আমি তখন নিচের বসার ঘরেই ছিলাম।
ভদ্রলোক এসে বাবার খোঁজ করল, বাবা আছে শুনে একটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে তাকে খবর দিতে বলল। আমি পা বাড়াবার আগেই জিজ্ঞাসা করল, তুমি সুমন সরকার?
আমি মাথা নাড়লাম।
ঠিক আছে, বাবাকে খবর দাও!
যেতে যেতে কার্ডটা উল্টে দেখলাম, নামের নিচে লেখা আছে, অ্যাটর্নি। একটু বাদে কার্ড হাতে বাবা অবাক মুখে নিচে নেমে এলো। আমারও হঠাৎ কৌতূহল। কেমন…ভদ্রলোক আমার নাম জানল কি করে! আমিও বসার ঘরের পিছনে এসে দাঁড়ালাম।
তারপর উৎকর্ণ হয়ে ভদ্রলোকের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুনলাম।…সে বিপাশা দেবীর অ্যাটর্নি, এই বাড়ির যাবতীয় স্বত্ব বিপাশা দেবী আগামীকাল নাবালক সুমন সরকারের নামে দান-পত্র করে দিচ্ছেন। যতদিন না সুমন সরকার সাবালক হচ্ছে ততোদিন সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব বিপাশা দেবীর নিজের হাতেই রাখছেন।
এ-সব আমাকে বলার কারণ? বাবার গম্ভীর গলা।
অমায়িক সুরে ভদ্রলোক জবাব দিল, বিপাশা দেবী আপনাকে খবরটা জানিয়ে রাখতে বলেছেন, তাই।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
বাবা ঘর থেকে বেরুবার আগেই আমি ছুটে ওপরে চলে এলাম। বেশ উত্তেজনা বোধ করছি। খবরটা কোনো ফিকিরে নতুন মা-কে জানিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। নতুন মা আবার তখন আমার ঘরে দাঁড়িয়েই সাগ্রহে দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবি দেখছে। তার এ আগ্রহ এরই মধ্যে আরো অনেকবার লক্ষ্য করেছি। আর তার মুখ দেখে আমি কল্পনা করে নিয়েছি, বাবার ওপর ভিতরে ভিতরে অন্তত এই নতুন মা সদয় নয়, সদয় হতে পারে না।
পরদিন বাড়ি আমার নামে রেজিস্ট্রি হবার কথা। হয়েছে নিশ্চয়। তার পরদিন। আমি এলাম মায়ের কাছে। মা ডাকে নি, নিজে থেকে এসেছি। মায়ের দুর্বলতা আমার জানা হয়ে গেছে, সেটাই আমার মস্ত জোর-বাড়ি আমার নামে লিখে দিয়েছে বলেই আমি তাকে রেহাই দেব! অমন শর্মা সুমন সরকার নয়।
আমাকে দেখে মা খুশি আবার উতলাও একটু। মুখের দিকে চেয়ে মায়ের ভিতরটা আজকাল অনেক বেশি দেখতে পাই আমি।