দূরে কোথা থেকে একটা সানাইয়ের শব্দ ভেসে এলো কানে। আমি চমকে উঠলাম। …স্কুল থেকে এসে পর্যন্ত বাবাকে দেখি নি। রাতেও দেখি নি। সন্ধ্যার পর বাবা তো বাইরে থাকে না বড়। নিজের ঘরে বসে মদ খায়।…আজ কোনো বিয়ের দিন নাকি?
উঠলাম। ঘরের আলো জ্বালোম। বাবার আর আমার ঘরের মাঝের দরজা হবার আমিই বন্ধ-রাখতুম। সেটা খুললাম। বাবার ঘর অন্ধকার। ভিতরে ঢুকে সুইচ টিপলাম।
ঘরে কেউ নেই।
কত রাতে ঘুমিয়েছিলাম, জানি না। সকালে উঠে মালতী মাসিকে কোথাও দেখলাম না। আমার বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। একটা চাকরকে জিজ্ঞেস করতে সে জানালো, খুব ভোরে উঠে মালতী মাসি ট্যাক্সি ডাকিয়ে কোথায় চলে গেছে। সঙ্গে তার স্যুটকেস আর ছোট একটা বিছানা ছিল।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে মা-কে দেখি নি। আজ ঘুম ভেঙে উঠে মালতী মাসিকে দেখলাম না।
আমার খণ্ডিত সত্তার সাত বছরের দিকটা ডুকরে কেঁদে উঠতে চাইল। আর তের বছরের আমি সুমন সরকার তার টুটি চেপে ধরলাম।
মায়ের টেলিফোন নম্বর আমার জানা ছিল। কিন্তু এতদিনের মধ্যে সেধে কখনো ফোন করি নি। আজ এই প্রথম একটু বেলা হতে মাকে টেলিফোনে ডাকলাম।
আমি সুমন। মাসি খুব ভোরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
সে কি রে! মায়ের গলার স্বরেই বোঝা গেল, মাসি তাকেও গোপন করেই গেছে, কোথায় গেল?
জানি না। কাল রাতে আমাকে বলেছিল, তোর নতুন মা আসছে। বাবা কাল থেকে বাড়ি নেই, আজ নতুন মাকে নিয়েই বাড়ি ফিরবে বোধ হয়।
ও-দিকের সাড়াশব্দ নেই, অর্থাৎ মা স্তব্ধ।
খানিকক্ষণ বাদে গলা শোনা গেল, গাড়ি পাঠাচ্ছি, তুই আয় একবার।
না।
টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
মালতী মাসির গত রাতের স্পর্শটা আমাকে ঘেঁকে ধরে আছে, আর তার কান্না ভরাট কথাগুলো কানে লেগে আছে। আমি শুধু ভাবছি আর ভাবছি, ভাবছি। ভিতরের। যে অবুঝটা অব্যক্ত যাতনায় ছটফট করছে, তাকে আমল দিচ্ছি না। শুধু ভাবছি, মাসি কোন্ পাপ আর কোন লোভের কথা বলল গত রাতে?
কোনো হদিস মেলে নি। পরে পরিণত বয়সে একটা সম্ভাব্য সমাধান আমার মাথায় এসেছে। সেটাই সত্য বলে বিশ্বাস।
মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির আগে বাবার সন্দেহ আর ঈর্ষা রোগের আকার নিয়েছিল। মা বাইরে শুটিং-এ গেলে মাসি সঙ্গে থাকত, স্টুডিওতেও যেত মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে। মনে হয়, বাবার ওই সন্দেহ আর ঈর্ষা রোগের রসদ মাসিই জুগিয়েছে।
কিন্তু আশ্চর্য, ধারণাটা সত্যি হলেও মালতী মাসির ওপর আমার এতটুকু রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। বরং অফুরন্ত মায়া তার ওপর।… যেখানেই থাকুক, যদি থাকে আজও তার বুকের যন্ত্রণা জুড়োক।
.
বলা বাহুল্য, শুরু থেকেই নতুন মা-টিকে আমি একটুও সুনজরে দেখি নি। এ-বাড়িতে তার প্রথম পদার্পণের রাতেই তাকে তেরো বছরের ছেলের বিদ্রোহ মূর্তি দেখতে হয়েছিল। সেই ছেলের ভিতরের বয়স কত, সে জানবে কি করে?
বিদ্রোহের ফলও বাবা হাতে হাতেই দিয়েছিল। কিন্তু সে আমার গায়ের ধুলো।
সন্ধ্যার ঠিক পরেই নতুন মানুষ সঙ্গে নিয়ে বাবা বাড়ি ফিরেছে। দোতলা থেকে দেখে আমি নিজের ঘরে ঢুকে গেছি।
একটু বাদে হাসি-হাসি মুখে বাবা ঘরে ঢুকল। পিছনে সেই একজন। আমার পড়ায় অখণ্ড মনোযোগ। বাবার গলার এমন মোলায়েম সুর আর শুনি নি, বলল, সুমন, দেখ কে এসেছে–তোর নতুন মা।
বই থেকে মুখ তুলে আমি ফিরে তাকালাম। নতুন মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হল। হাসিমাখা বেশ সুন্দর মুখখানা। কিন্তু ও-সব দেখার চোখ নয় আমার তখন। অবশ্য কি দেখছি, তাও জানি না।
তুমি ওর সঙ্গে কথা বলো। বাবা ঘর ছেড়ে চলে গেল।
নতুন মা হাসি-হাসি মুখে আমার দিকে এগিয়ে এলো। চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়াল। একটা সুঘ্রাণ নাকে এলো আমার। গলায় মোটা ফুলের মালা আর সেন্টের মিষ্টি গন্ধের মিশেল।
তুমি সুমন?
আমি সামান্য মাথা নাড়লাম কি নাড়লাম না। দেখছি।…বছর ছাব্বিশ সাতাশের বেশি বয়স হবে না, মায়ের এখন বত্রিশ। মায়ের থেকে স্বাস্থ্যও খারাপ। মায়ের থেকে ফর্সা আর বেশ সুশ্রীও, কিন্তু মায়ের মতো মিষ্টি মুখ নয়, চোখ তো নয়ই।
হঠাৎ নিজের ওপরেই কেমন রাগ হয়ে গেল আমার। একে দেখামাত্র মায়ের সঙ্গে তুলনা কেন?
তুমি আমাকে দেখে একটুও খুশি হও নি তো?
জবাব না দিয়ে আমি বইয়ের দিকে চোখ ফেরালাম। নতুন মা আরো একটু কাছে এলো! হাত বাড়িয়ে বইটা তুলে নিল, দেখল কি বই, তারপর আবার সেটা সামনে রাখল।
আমাদের সময় অ্যালজেব্রা পড়তে হত না, খাতায় কষতে হত, তোমাদের বুঝি মন দিয়ে অ্যালজেব্রা পড়তে হয়?
আমি আবার ফিরে তাকালাম। বললাম, পড়তে হয় না, আসলে আমার এখন তোমার সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছে নেই।
দুচোখ আমার মুখের ওপর থমকে রইল একটু। তারপর আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তার দোষ নেই, সে আমাকে তের বছরের একটা ছেলেই ভেবেছিল শুধু।
মালতী মাসি নেই, মালতী মাসি আর এ-বাড়িতে কোনদিন আসবে না, আমার রাতে ঘুমুবার সময় আর কোনদিন পাশে থাকবে না– ভিতরের এই ক্ষুব্ধ যন্ত্রণাটা নতুন করে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
বাবা মনের আনন্দে নতুন মা-কে বাড়ি-ঘর দেখাচ্ছে। নীচের তলায় ঘুরে এলো, দোতলার সব কটা ঘরে চক্কর খেলো, ছাতেও ঘুরে এলো নতুন মা-কে নিয়ে। তারপর নিজের ঘরে ঢুকল। ঘণ্টা দুই কাটল সবসুন্ধু।