পর্দার ফাঁক দিয়ে দুজনকেই দেখা যাচ্ছে। বাবা আর মালতী মাসি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে চাবুকের এক ঘা মাসির ওপর পড়েছে, এখন আবার কি হয়, কে জানে।
মাসির গলায় এই সুরও অদ্ভুত যেন।হঠাৎ ওকে শাসন করার দরকার হল কেন?
বাবা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তা দিয়ে তোমার কি দরকার?
দরকার আছে। তখন যা সব বললাম সেটা তোমাকে সাবধান করার জন্যে, ওকে শাসন করার জন্যে নয়। মা চলে যেতে ছেলেটা ভিতরে ভিতরে পুড়ছে, চাবুক নিয়ে ওর ওপর বিক্রম দেখাতে লজ্জা করা উচিত।
মাসির কথা শুনে আমার কান জুড়োলো বটে, কিন্তু আমি তাজ্জবও তেমনি। মালতী মাসি বাবাকে তুমি করে কথা বলছে!
সেই রাতেই আবার মাসিকে অদ্ভুত ভালো লেগেছে আমার। রাত্রিতে যখন। আমাকে ঘুম পাড়াতে এলো, তার বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকার লোভও ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল।
.
আসলে আমার সব দুষ্টুমি আর শয়তানির লক্ষ্য মা। অর্জুন যেমন আর একদিকে চেয়ে লক্ষ্যভেদ করেছিল, আমার সমস্ত আচরণও তেমনি যে পথেই ধাওয়া করুক, আসলে সেগুলো মায়ের বক্ষ ভেদ করতে চেয়েছিল।
দিন গেছে, মাস গেছে, একটা দুটো করে গোটা কয়েক বছর ঘুরেছে, কিন্তু আমার ভিতরটা ঠাণ্ডা হওয়ার বদলে সর্বদাই মাকে আঘাত করতে চেয়েছে। মা আমার খোঁজ খবর করে, আমার ভালো শুনলে খুশি হয়, মন্দ শুনলে দুঃখ পায়, এটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভালোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক হেঁটে দিতে ইচ্ছে করেছে। আমি কি করলে মা কষ্ট পাবে, যন্ত্রণা পাবে, তার নতুন নতুন রাস্তা বার করতে পারাটাই যেন মস্ত কাজ।
পরের পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে মায়ের কাছে আরো অনেক বার গেছি। মালতী। মাসি যখনই বলে, চল তোর মায়ের ওখান থেকে ঘুরে আসি একটু, তক্ষুনি বুঝতে পারি, মা আমাকে দেখতে চায়। মাসির বেশি আগ্রহ দেখলে ভিতরের হাজার লোভ চেপে না গিয়ে মায়ের ইচ্ছেটাই যেন বরবাদ করে দিয়েছি। মা যদি বলে ডাইনে যেতে আমি অবধারিত বায়ের রাস্তা ধরব, যদি বলে উত্তরে হাঁটতে, আমার পা দক্ষিণে ছোটার জন্য সুড়সুড় করবে।
ভিতরের এই পুঞ্জীভূত আক্রোশ থেকে কোনদিন মুক্তি পাব কিনা, জানি না।
এ-কবছরের মধ্যে একে একে দুটো বাড়িতে বাস করতে দেখেছি, মা-কে। সেই বাড়িতে অন্য পুরুষ মানুষও দেখেছি। ব্যাপারটা বুঝতে আমার একটুও সময়। লাগে নি। সেই দুটো বাড়ির দুই কর্তাই আমাকে আদর করে কাছে টানতে চেয়েছে। না, তাদের সঙ্গে সামনাসামনি কোন রকম অভদ্র আচরণ করতে পারিনি। সেটা করেছি মায়ের সঙ্গে। মা কখনো বিরক্ত হয়েছে, কখনো রেগে গেছে, কখনো বা অসহায় বোধ করেছে। আমার ব্যাপারে মায়ের ভিতরের প্রতিক্রিয়া আমি মুখের দিকে তাকালে অনুভব করতে পারি। বারো-তেরো বছর মাত্র বয়স তখন, আমার খণ্ডিত সত্তার বহির্মুখী অংশ ওই বয়সটাকে অনেক ছাড়িয়ে গেছে।
একগাদা মন্দ ছেলে আমার সঙ্গী-সাথী তখন। পাজি ছেলেদের সঙ্গে মিশলে মা মন্দ বলে, বাবাও রাগ করে। অতএব ওরাই প্রিয় আমার। তাছাড়া সঙ্গবদ্ধভাবে শয়তানি করার মধ্যে এক ধরনের রোমাঞ্চ আছে। তারা আমাকে লুকিয়ে সিগারেট খেতে শিখিয়েছে, মেয়েদের রহস্যের দিকে তির্যক দৃষ্টি হানতে শিখিয়েছে। এদের মধ্যে সব থেকে পাকা ছেলে জিতু, জিতেন পোদ্দার। বয়সে আমার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে, গায়ে শক্তিও রাখে তেমনি! বছর দুই ফেল করে আমার সহপাঠী হয়েছে। স্কুলের মার্কামারা ছেলে হয়ে উঠেছিল, সে এরই মধ্যে। মিশনারি স্কুল, তাই ফিরিঙ্গী রেক্টর সাহস করে ওকে স্কুল থেকে তাড়াতে পেরেছে। এখন তার পাড়ার। স্কুলে ভর্তি হয়ে আরো মাতব্বর হয়ে উঠেছে। আমাদের খুদে দলের লিডার সে-ই।
আমার সঙ্গে খাতির–কারণ আমি ওকে সিনেমা দেখা, সিগারেট আর চপ কাটলেট খাওয়ার খরচ জুগিয়ে থাকি মাঝে মাঝে। কোনো একটা দরকারের অজুহাতে টাকা চাইলেই মালি দেয়। আমার ধারণা, ধারণা কেন, আমি ঠিক জানি, মা তার হাতে আমার জন্যেই টাকা দেয়। আমার স্কুল-বই-খাতা-জামাকাপড় ইত্যাদির যাবতীয় খরচ এখনো নিশ্চয় মা দেয় বলে বিশ্বাস।
সেই জিতু পোদ্দার হঠাৎ সকলের সামনে এক চোখ বুজে আমাকে ডাকল, এই শোন
কাছে যেতে জিজ্ঞাসা করল, তোর মা এখন কার সঙ্গে থাকে রে?
শোনামাত্র আমার মাথার মধ্যে কি-যে হয়ে গেল, কে জানে। আমি পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর ওপর, সঙ্গে সঙ্গে ঘুষি-চড়-লাথি।
আচমকা আক্রান্ত হয়ে ও হকচকিয়ে গেছল। কিন্তু এমন মান্যগণ্য লিডার, স্তাবকদের সামনে এ-অপমান হজম করার পাত্র নয় সে। ওর বাবা পর্যন্ত এখন এ ভাবে গায়ে হাত তুলতে সাহস করে না। সামলে নিয়েই এক ঘুষিতে আমাকে চিৎপাত করে ফেলল।
তারপর…
তারপর আমার মুখ আর মাথা মাটিতে থেতলে দিতে লাগল। আমার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের মতো ও আমাকে একেবারে শেষ না করে ক্ষান্ত হবে না বুঝি। আমার নাক-মুখ রক্তে ভাসছে।
কোন রকমে টলতে টলতে বাড়ি ফিরলাম যখন, আমাকে দেখে মাসি আর্তনাদ করে উঠল। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।
জ্ঞান হতে দেখি, ডাক্তার আমার মাথায় আর কপালে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে। পাজি ছেলের সঙ্গে মারামারি করে এই দশা হয়েছে আমার সেটা বাবা নিজেই বুঝে নিয়েছে হয়তো। দাঁত কড়মড় করে বলে উঠেছে, শিক্ষা হয়েছে তো? বেশ হয়েছে, আর মিশতে যাবি ওই সব ছেলের সঙ্গে?