মায়ের চোখে-মুখে এবারের যন্ত্রণা দেখে আমি রীতিমতো আনন্দ পাচ্ছি। এই যন্ত্রণা রাগ হয়ে জমাট বাঁধছে। মাসির দিকে তাকিয়েছি আবার।
মালতী মাসি যেন বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। মায়ের চোখ এড়িয়ে আমার দিকে ফিরল, তুই বেশি বেশি বলিস না তো! _ বেশি বেশি। সামান্য কথায়ও কেন যে এত রাগ হচ্ছে আমার, জানি না। প্রথম দিন চড় খাবার পর জল দিয়ে ঘষে আমার গাল থেকে তুমি বাবার আঙুলের দাগ তুলতে চেষ্টা করো নি, বাবার চামারের হাত বলোনি? মায়ের দিকে ফিরলাম, মাসি তো এখন বাবার দিক টেনে বলবেই, বাবার সঙ্গে খুব যে এখন
নিঃশব্দে কিছু একটা চকিত কাণ্ড হয়ে গেল, মনে হল। মাসি যেন ধড়ফড় করে উঠল, তার কালো মুখখানা শুকিয়ে আমসি। আর মাও যেন স্বস্তি বোধ করছে না একটুও। জোর করেই যেন বিস্মিত দুচোখ মাসির দিকে ফেরালো।
মালতী মাসি খানিকটা আমতা আমতা করে বলল, তুমি নেই, তাই আমার কাছ থেকেই সর্বদা ওর ঘরোয়া খবর নেয়…
মৃদু-কঠিন স্বরে মা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু ওকে হঠাৎ এত শাসন করার দরকার হয়ে পড়ল কেন?
দিনকতক ভয়ানক দুষ্টুমি করছিল আর অবাধ্য হয়েছিল, খাওয়া দাওয়া করছিল না, স্কুলে যাচ্ছিল না—-
তুমি যে ফোনে বলতে, খুব ভালো হয়ে আছে ও, ওর জন্যে কিছু ভাবতে হবে না?
তেমনি বিব্রত, মুখ করে মাসি জবাব দিল, গোড়ায় কটা দিন খুব অবাধ্যপনা। করছিল, এখন আর করে না…অশান্তির মধ্যে আর তোমার ভাবনা বাড়াতে চাই নি বলে বলিনি।
জবাবদিহি শোনার পরেও মাকে একটু তুষ্ট মনে হল না। রাগ সত্ত্বেও ভিতরে ভিতরে আমার এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে।
মা আবার আমার দিকে ভালো করে ঘুরে বসল। এত দুষ্টুমি করিস কেন?
বেশ করি!
আগে মুখের ওপর এমন কথা কখনো বলেছি কিনা, মনে পড়ে না। অবাধ্য। হলে মায়ের দুই ভুরুর মাঝে যেমন বিরক্তির ভাঁজ পড়ত, আর চাউনির মধ্যে যেমন বকুনি মিশে থাকত–তেমনি দেখছি।
ফের এ-রকম শুনলে খুব রাগ করব!
পিছনে কিসের শব্দ হতে ঘুরে তাকালাম। একটা চাকর ছোট টেবিল পেতে দিল, আর একজনের হাতে মস্ত দুটো খাবারের ডিশ। আমার সাত বছর বয়সের। মগজে তক্ষুনি আবার একটা দুষ্টুমির ছাপ পড়ে গেল। আমি জানি, এখন কি করলে মা আরো কষ্ট পাবে। কিন্তু তার আগে আমার কিছু বুঝে নেবার আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কি করে রাগ করবে, শুনবে কি করে?
তুই কখন কি করিস, না করিস, এখানে বসেই আমি খবর পাব।
তুমি আর বাড়ি যাবে না?
না।
আমাকে এখানে থাকতে দেবে?
মা যেন থতমত খেল একটু। তা কি হয়, ওটা আসলে তোরই নিজের বাড়ি, খুব লক্ষ্মী হয়ে থাকবি, ভালো করে পড়াশুনা করে বড় হবি।
আমি কিছু হব না, কিচ্ছু না! যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াব, তুমি যত খুশি রাগ। করো। ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে আরো কি যে হয়ে গেল, কে জানে–এক ধাক্কায় ছোট টেবিলের খাবার ভর্তি ডিশ দুটো উল্টে ফেলে দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সোজা নিচে, তারপর গেটের বাইরে।
মালতী মাসিও পিছন পিছন ছুটে এসেছে। খপ করে একটা হাত ধরেছে আমার। হাত ছাড়াবার অজুহাতে আমি সরোষে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।…মা দোতলার বারান্দায় রেলিং য়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকেই চেয়ে আছে। ভেবেছিলাম, হাত নেড়ে আবার ডাকবে আমাকে। ডাকল না। শুধু চেয়েই রইল। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
বাড়ি ফেরার আগেই বোঝা গেল মাসি কত চটেছে আমার ওপর। সমস্ত পথ একটি কথাও বলল না। সন্ধ্যায় বাবার ঘরের দিকে যেতে দেখলাম তাকে। কি কথা হল, জানি না, তার খানিক বাদে বাবা আমার ঘরে এলো, আগে হলে ওই মুখ আর ওই চাউনি দেখে, ভয়ে কেঁপে উঠতাম আমি।
কিন্তু আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে আমার ভয় ডরের লেশমাত্র নেই।
মায়ের কাছে গিয়ে কি বলেছিস? আর অমন অভদ্রতা করে এসেছিস কেন?
আমি চুপ। বাবার দিকে চেয়ে আছি। আমাকে পিটতে এসেছে, তাও বেশ ভালই, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার সব ভয় যেন ঘৃণা হয়ে কিলবিল করছে ভিতরে।
বাবার হাত দুটো পিছনে ছিল। সেই হাত সামনে আসতে দেখলাম, মুঠোর মধ্যে তার শৌখিন চাবুকটা। হ্যাঁচকা টানে আমাকে কাছে নিয়ে এলো।
তার পরেই আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল একটা। চাবুকসুদ্ধ বাবার হাত উঠল, নেমেও এলো, তার আগেই আমি চোখ বুজে ফেলেছিলাম। কিন্তু ওটা আমার গায়ে না পড়ে শপাং করে আর কারো গায়ে পড়ল যেন। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই মালতী মাসি আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে সরে গেল। তারপর দুহাতে আমাকে জাপটে আগলে রেখে বাবার দিকে ঘুরে তাকালো।
ছাড়ো বলছি! বাবা চাপা গর্জন করে উঠল।
আমি অবাক! মাসির দিকে চেয়ে আর মাসির কথা শুনে। এ কি সেই মাসি, কদিন আগেও যে ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকত! মাসির কালো মুখও রাগে থমথম করছে। হাত ধরা অবস্থায় আমাকে পিছনে রেখে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ওর মা অনেক জেনেছে, এও জানতে বাকি থাকবে না।
বাবা চেঁচিয়ে উঠল, আই ডোন্ট কেয়ার, তুমি সরো!
মাসি সরল না, নড়ল না। পিছন না ফিরে আমাকে বলল, সুমন চলে যা এখান। থেকে–
আমি যতো ত্যাদড়ই হই, বয়স তো মাত্র সাত। পালাবার ফাঁক পেলে কে আর সেধে মার খেতে চায়! পিছনের দরজার পর্দা ঠেলে প্রস্থান করলাম। পিছনের ঘরটা অন্ধকার। নিরাপদ ব্যবধানে এসে আমার পা আর নড়ল না। আলো না জ্বেলে ঘুরে দাঁড়ালাম।