কচি মুখের ওই কথা শুনে আমার তাজ্জব লাগে। বলিস কি রে! আমি তো শুধু মাঝে মাঝে নিজেকেই মারতে চাই!
একই কথা। সেই মারও শেষ পর্যন্ত মায়ের বুকে গিয়ে লাগবে, তুমি ভালই জানো। আমার সঙ্গে তোমার অনেক তফাত, আমি মায়ের জন্য কেঁদে মরছি, আর তুমি মায়ের ওপর কেবলই ফুসছ।
কিন্তু তোর ফোস-ফোসানি জমা করে করেই তো আমি এত বড় হয়েছি, আর আমার এই হাল হয়েছে! এখনো এই দুর্দশাই চলেছে। বোকার-মতো নিজেও ভুগছিস, আমাকেও ভোগাচ্ছিস। তার থেকে চলে আয় আমার কাছে, আমার মধ্যে থেকেও এভাবে আলাদা হয়ে থাকিস নে।
না না! ও মাথা ঝাঁকিয়ে ক্ষোভটা আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়। আমি আলাদা বলেই আমাকে তুমি কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমার জন্যে তুমি আধখানা হয়ে না থাকলে এতদিনে তুমি কটা খুন করে বসতে ঠিক নেই। মায়ের কথা ছেড়ে দাও, আমি না থাকলে ওই যশোদা আর শোভা আর ওই মিতাকেই কি তুমি আস্ত রাখতে? মরে কালি মেরে যেত না ওঁরা এতদিনে?
আমি যখন ওকে আদর করে ডাকি, ও আমাকে তখন এমনি করেই নাস্তানাবুদ করে। বললাম, তুই তো ওই ছোটটিই হয়ে আছিস, ওরা কে কেমন, বা আমার কাছে কি চেয়েছিল আর কোন মৃত্যুর স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল, তুই জানবি কি করে?
ও মুখ মুচকে জবাব দিল জানার দরকার কি! মেয়েছেলে দেখলেই তুমি তার। মধ্যে ভর-ভরতি মেয়ে দেখো আর অমনি অপমানের আগুনে তাকে দগ্ধে মারতে চাও। আর আমি তাদের মধ্যে মা-কে খুঁজি, মা-কে খুঁজে বার করে তোমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তবে তুমি হাত গোটাও। শোভা-মিতারা ভাবে, বাইরে। তুমি যেমনই হও, ভিতরটা তোমার কত সুন্দর, দরদের পাতে মোড়া। ওদের ছেড়ে নিজের পঁয়তাল্লিশ বছরের মাকে তুমি কোন্ মূর্তিতে দেখো এক এক সময় জানো না? সেদিন থিয়েটার হলে গ্রীনরুমের একগাদা মেয়ের সামনে মায়ের গলা টিপে ধরার জন্য তোমার হাত নিশপিশ করে ওঠেনি? সেদিনও আলাদা হয়ে তোমাকে না আটকালে কি হত?
ওর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। আমারই বুদ্ধি নিয়ে ও এঁচড়ে পেকেছে। না, হাত যতই নিশপিশ করুক, রক্ত যতই মাথায় উঠুক–কিছুই আমি করতাম না। ওই। খুদেটা আমার ভিতর দেখতে পায় বলে ভয় পায়।
হ্যাঁ, মনে আছে। নতুন চমক লাগানো নাটক চক্র দেখতে আমিও গেছলাম। অনেক আগে থেকে চেষ্টা করে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়েছে অন্যের মারফত। অপরের মারফত কারণ, সিনেমা রাজ্য আর থিয়েটার জগতের প্রায় সমস্ত কর্মকর্তারাই মায়ের দৌলতে আমাকে চেনে। এও আমার এক বড় রকমের দুর্ভাগ্য। দেখে ফেললে আর। চিনে ফেললে সকলেই খাতির করে, ঘটা করে আপ্যায়ন জানায়।
.
চক্র নাটকে নামধন্যা নায়িকা বিপাশা দেবীর রঙ্গমঞ্চে দ্বিতীয় দফা এই বৃহৎ আবির্ভাব। প্রথম বার প্রায় এক বছর ধরে বিজয়িনী নাটকে অভিনয় করে থিয়েটারের মালিকদের টাকার তহবিল ফঁপিয়ে তুলেছে। সেটা ছিল ইতিহাসভিত্তিক আখ্যান। এটা সামাজিক।
মা ইন্দুমতী চিত্রজগতের যশস্বিনী নায়িকা বিপাশা দেবী। আজ অনেক বছর হয়ে গেল ওই নামের সঙ্গে দেবী যুক্ত। ব্যক্তিজীবনে বার কয়েক পদবী বদল হয়েছে কিন্তু শিল্পী-জীবনে দেবী স্থায়ী আসন নিয়েছে। গোড়ায় ছিল বিপাশা সরকার–ঘরে যখন ইন্দুমতী সরকার।
বাইশ থেকে উনচল্লিশ–এই দীর্ঘ আঠার বছর সে ছিল ছায়াচিত্র জগতের সম্রাজ্ঞীর মতো। উদ্ধত আত্মচেতন অনন্যাগোছের কেউ নয়। বরং উল্টো। মার্জিতরুচি, সরলবুদ্ধি, বিনয়ন, নির্ভরশীল আচরণ সকলের সঙ্গে। এটাই তার বড় আকর্ষণ, এতবড় সাফল্যের পিছনে এটুকুই বড় পুঁজি। আমি তাকে কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকে দেখেছি। তার কোন আচরণ অভিনয় আর কোনটা নয়, তা আজও আমার কাছে স্পষ্ট নয় খুব। বাঘা সমালোচকরা তার সম্পর্কে বলে থাকে, মহিলা কোনো সময় অভিনয় করে না বলেই, এত বড় অভিনেত্রী সে। এক বড় অভিনেত্রী সে। এক একসময় মনে হয়, খুব অতিশয়োক্তি নয়। ছবিতে যেমন, ছবির বাইরেও তেমনি। শান্ত স্নিগ্ধ, ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু মৃদু হাসি, ডাগর সরল চাউনি–আবার প্রয়োজনে অটুট গম্ভীর তীক্ষ্ণ কঠিন অচপল অচঞ্চল। ছবিতে তার এই দুই রূপ, ঘরেও। অবশ্য আমি যে ঘরের কথা বলছি সেটা আমাদের ঘর-উনিশ বছর আগের আমাদের সেই ঘর। তারপরেও এ যাবত বহুবার তাকে দেখেছি, তার ঘরে দেখেছি, ঘরের বাইরেও দেখেছি। আমার ধারণা ওই রূপের রকমফের খুব একটা হয় নি। আর ভিতরে বাইরে ওই রূপ মিশে আছে। ওই দুটো রূপ তার ঘর ভেঙেছে আবার নতুন ঘরের হাতছানি আর আশ্বাসও জুগিয়ে এসেছে! তার থেকেও বড় কথা–ওই দুটো রূপই তার এতবড় প্রতিষ্ঠার মূল ভিত। তাই এমন এক সার্থক রূপের আজও খুব একটা রং-বদল হয়েছে। বলে মনে হয় না।
এত বড় অভিনেত্রী ইদানীং রঙ্গমঞ্চের দিকে ঝুঁকেছে কেন, সে সম্পর্কেও আমার একটা সাদা-সাপটা ধারণা আছে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দাগটা ক্যামেরায় ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। উনচল্লিশ বছর পর্যন্ত প্রসাধন আর মেক-আপ-এর দৌলতে টেনেটুনে চালানো গেছে। চালানো গেছে বলতে নায়িকার ভূমিকা উতরে দেওয়া গেছে। তারপর আর সেটা সম্ভব হয়ে উঠছিল না, বয়সের ছাপ পড়ছিলই। ফলে এখন আর নায়িকা নয়, নায়িকাসদৃশার ভূমিকা তার। আজও বক্স-অফিস আর্টিষ্ট হিসেবে বিপাশা দেবীর নামটা তুচ্ছ নয়, কিন্তু প্রযোজক বা পরিচালকের তাগিদে গল্পের লেখককে তার কাহিনীতে নায়িকাসদৃশা দিদি বা বউদির ভূমিকা বুনে দিতে হয়। ছোট ছেলে বা মেয়ে বা মায়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো রো থাকলেও সবার আগে তার ডাক পড়ে।