সেই মানসিক অবস্থার মধ্যেও একটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেছি। যে মালতী মাসি মা বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে পর্যন্তও বাবার মুখোমুখি পড়ে গেলে ভয়ে চুপ মেরে থাকত, মা যেদিন থেকে আর বাড়ি ফিরল না, সেই রাতেও বাবা কথা শোনার জন্য তাকে ঘরে ডাকতে ভয়ে কাঠ হয়ে যেতে দেখেছি–সেই মাসি কিনা এরই মধ্যে দিব্যি সহজ হাসিমুখে বাবার ঘরে চলে যায়, তার সঙ্গে কথা-বার্তা বলে, এমন কি নাওয়া-খাওয়া বা স্কুলে যাওয়া নিয়ে আমি বেশি গোয়ার্তুমি করলে বাবাকে বলে দেবে বলে শাসায়ও! সেদিনের সেই অপরিণত মনও আমাকে বলে দিয়েছে, মালতী মাসি যতই ভালবাসুক আমাকে, মা চলে গেছে বলে ওই মাসি আমার মতো ব্যথা একটুও পায় নি। রোজকার মতো তার পরেও সে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে গেছে, কিন্তু একদিনের জন্যও মায়ের ওই জায়গাটা আমি তাকে দখল করতে দিই নি।
বাইরে আমার উগ্র ভাবটা দিন পনেরোর মধ্যে কমে এলো। ভিতরে যে ফাঁকা যন্ত্রণাটা থিতিয়ে থাকল, সেটা কেউ দেখতে পায় না।….কি জন্যে স্কুলের ছুটি ছিল। সেদিন। দুপুরে মাসি চুপি চুপি আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এই, তোর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবি?
আমি চমকে উঠলাম। মা কোথায়?
আছে এক জায়গায়। যাবি তো চল, তোর মায়ের আজ ছুটি। বিকেলে তোর। বাবা আসার আগেই চলে আসব আবার। খবর্দার, তোর বাবাকে একটি কথাও বলবি না!
আমি চুপচাপ খানিক মাসির মুখখানা দেখে নিলাম। মা কোথায় আছে আর আজ ছুটি, তুমি জানলে কি করে?
একটু আগে তোর মা ফোন করেছিল, আগেও দুই একদিন ফোনে তোর খবর নিয়েছিল।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, আমাকে তুমি কিছু বলো নি কেন? কেন বলো নি? দাও, আমাকে ফোন নম্বর দাও।
আমার রাগ দেখে মাসি গায়ে পিঠে হাত বোলাতে এলো। ছিঃ রাগ করতে হয় না, তোর মা যে তোকে ফোন নম্বর দিতে বারণ করেছে।
একটা দগদগে ক্ষতের ওপরে যেন আগুন ছিটিয়ে দিল কেউ। ঠিক আছে, আমি যাব না, মা-কে বলে দাও, সুমন মরে গেছে!
ছুটে চলে এসে নিজের বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম। একটু পরে মাসি আবার গায়ে-পিঠে হাত বোলাতে এলো, আমি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম।
লক্ষ্মী মাণিক, অমন করে না, মাসির মিছরি-ভেজানো গলা একেবারে, তোর। মা যে তোকে ডেকেছে, তুই যাবি বলে আজ কোথাও বেরুচ্ছে না–না গেলে এমন রাগ করবে যে আর কোনদিন হয়তো তোর সঙ্গে দেখাই হবে না–চল, চটপট ঘুরে আসি, সন্ধ্যার আগেই আবার ফিরে আসতে হবে তো!
উঠে বসলাম। মুখ গুঁজে পড়ে থাকলেও চোখ দিয়ে আমায় জল গড়াচ্ছিল না। ভিতরে যা-ই হতে থাকুক, ওই বয়স থেকেই চোখ আমার খরখরে শুকনো। রাগ পড়ে নি, কিন্তু মা-কে দেখবার জন্য ভিতরটা আমার লালায়িত।
ট্যাক্সি থেকে নেমে আমার হাত ধরে একটা মস্ত বড় বাড়িতে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একটা চাকর আর একটা দারোয়ান গোছের লোক ছুটে এলো। আমাদের খুব খাতির দেখিয়ে দোতলায় নিয়ে গেল।
দোতলায় উঠেই দেখি, একটা ঘরের সামনে মা দাঁড়িয়ে। সেই মা–পিঠের ওপর খোলা চুল, পরনে সাধারণ একটা ফর্সা শাড়ি, বাড়িতে যেমন পরত।
বয়স আমার মাত্র সাত তখন, তবু মায়ের কি বেশ ব্যগ্র মুখ দেখেছিলাম আমি? মনে হয়, দেখেছিলাম। আর দেখেছিলাম বলেই আমার ভিতরের অভিমান অমন চাড়িয়ে উঠেছিল।
এসো মালতীদি। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাত ধরে মা আমাকে একটা মস্তবড় ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। আলনায় শাড়ি-টাড়ি দেখে বুঝলাম, এটাই মায়ের শোবার ঘর এখন। আমাকে বিছানায় বসিয়ে গা ঘেঁষে মা-ও বসল। মালতী মাসি আমাদের সামনেই একটা গদি-আঁটা মোড়া টেনে নিল।
দিব্যি হাসিমুখে মা জিজ্ঞাসা করল, আমার ওপর বুঝি খুব রাগ হয়েছে তোর!
আমি জবাব দিলাম না।
তোর মাসি বলছিল, তুই খুব লক্ষ্মী ছেলে হয়ে গেছিস, একটুও দুষ্টুমি করিস না, সকলের কথা শুনিস
অভিমান ও রাগ বাড়ছে। কেন যে প্রতিবাদ করা একান্ত দরকার হল, জানি না। মাসি মিথ্যে কথা বলেছে।
ও মা, সে কি রে! মায়ের গলার স্বরে তখনো হাল্কা কৌতুক।
আগের থেকে আরো বেশি দুষ্টুমি করি, কারো কথা শুনি না।
মা আমার দিকে চেয়ে রইল, হাসিমাখা চাউনি, কিন্তু মুখের দিকে চেয়ে যেন ভিতরটা দেখে নিচ্ছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস তো?
না।
পড়াশুনা?
বই ছুঁইও না।
খুব খারাপ কথা, মা গম্ভীর একটু, পড়া না পারলে স্কুলে বকে না?
খুব। বাড়ির মাষ্টারমশাই সেদিন কানটা ছিঁড়ে নিচ্ছিল প্রায়।
কেন যে কথা কটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কে জানে। বলার পর মনে হল, শুনে মা যেন একটু যন্ত্রণা বোধ করল। মা থাকতে বাড়ির মাষ্টার সত্যিই কোনদিন আমার গায়ে হাত দেয় নি। মাষ্টারমশায়ের কাছে আমার অপরাধের প্রসঙ্গ অনুক্ত থাকল। তিনবার করে বলার পরেও আমি যখন পড়ায় মন দিচ্ছিলাম না, মাষ্টারমশাই জোর করে আমার মাথাটা বইয়ের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, আর আমি তখন হঠাৎ রেগে গিয়ে বিকটভাবে তাকে ভেংচি কেটে উঠেছিলাম।
মা মালতী মাসির দিকে তাকালো একবার। চাপা গলায় হুকুম করল, গায়ে হাত তুলতে বারণ করে দিও।
শোনামাত্র আমার রাগ আবার শয়তানির আকারে চাড়া দিয়ে উঠল। আমার ওপর গঞ্জনাটা মায়ের একটু যন্ত্রণার কারণ, সেটা আরো স্পষ্ট করে বোঝা গেল। বললাম, মাষ্টারমশাই কি এমন গায়ে হাত তোলে, বাবার এক-একটা চড় খেয়ে প্রায়ই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে হয়।