মালতী মাসি অবশ্য এক এক সময় মায়ের দিক টেনেও কথা বলত। তোর বাপেরও বুদ্ধির দোষ, আগে তোর মাকে ফিল্মস্টার বানাবার জন্য ওই লাইনের পয়সাওয়ালা লোকদের কতভাবেই না তোয়াজ তোষামোদ করেছে। তখন এত উনার যে কোনো পার্টি থেকে তোর মা রাত বারোটায় কারো গাড়িতে বাড়ি ফিরলেও টু শব্দটি করে নি, আর যেই টাকার বৃষ্টি শুরু হয়েছে মাথায় অমনি শেকলে বাঁধার মতলব তোর মাকে–তাও কখনো হয়!
মালতী মাসির মুখে শুনেছি, চার বছর বয়সের সময় আমার একটা বোন হয়েছিল, সেই বোনকে আমি চোখে দেখি নি কখনো। মা দিনকয়েক মাত্র বাড়ি ছিল না, বাইরে শুটিং থাকলেও তো দু-পাঁচদিন করে হামেশাই বাড়ি থাকে না, কোথায় গেছল, আমি কি করে জানব?…নার্সিং হোমে মরা বোন হয়েছিল আমার, সেখান থেকেই সব ঝামেলা চুকেবুকে গেছে। কিন্তু বোন আসার ব্যাপারেই নাকি বাবার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া লেগেই থাকত। মায়ের জন্য তখন নাকি তিন-চার মাস ধরে অনেকের অনেক টাকা লোকসান হয়েছে কারণ মা তো তখন আর কাজ করতে পারে নি, তিন-চারটে ছবি আধা আধি শেষ করে ফেলে রাখতে হয়েছিল। সেইজন্যেই নাকি বাবার সঙ্গে মায়ের তখন অত ঝগড়া।
মনে মনে আমি তখন নানারকম কল্পনা করতাম। ওই অদেখা বোনের ওপর। আমার ভারী মায়া পড়ে গেছল। সে নিশ্চয় মায়ের ওপর রাগ করে একেবারে মরে জন্মেছে। মা আমাকেও চায় নি, ওকেও চায় নি। আমিও যদি ওই অদেখা বোনের মতই মায়ের ওপর শোধ নিতে পারতাম! মরে জন্মাতে পারি নি, কিন্তু এখন যদি মরে যাই? লোকে মরে যায় কি করে, সেওঁ তখন আমার কাছে আবার এক গবেষণার বস্তু।
নার্সিংহোম থেকে ফিরে এসেই মা আমাকে নিয়ে ঘর বদল করেছে। রাগের চোটে বাবা নাকি বাড়িতেই ছিল না কদিন। আর তারপর থেকেই বাড়িতে বসে মায়ের চোখের ওপর মদ খাওয়া ধরেছে। কিন্তু শক্ত ধাতের মা আমার, ও-সবে পরোয়া করার মেয়ে নয়।
এই ঘর টিকবে না, বাবা তার ঢের আগে থেকেই বুঝেছিল। গো ভরে যা-ই করুক, বুদ্ধি নেই তার, এ-কথা কেউ বলবে না। মাকে একটি কথাও না বলে খুব গোপনেই সে আবার নিজের ভবিষ্যৎ নির্বিঘ্ন করে তুলতে চেয়েছিল। মায়ের রোজগারের টাকা তখন মা আর বাবার দুজনের নামে ব্যাঙ্কে জমা হত। ইচ্ছে করলে দুজনের যে কোন একজন সেই টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারত। তাছাড়া সমস্ত টাকাই ব্যাঙ্কে
থাকত না, ইঙ্কাম ট্যাক্সের হানাদারী ঠেকাবার জন্য অনেক কাঁচা টাকা ঘরেও মজুত থাকত। এতদিন পর্যন্ত ব্যাঙ্কের চেক-বই আর ঘরের টাকা সবই বাবার হেপাজতে ছিল। মালতী মাসির ধারণা, বাবার মস্ত এক ইলেকট্রিক্যাল কারখানা ফেঁদে বসার ব্যাপারটা যখন জানাজানি হয়ে গেল, তার আগে ব্যাঙ্কে নগদ মিলিয়ে লাখ চারেক টাকা ছিল। কিন্তু টাকার খোঁজ পড়তে দেখা গেল, চারশ টাকাও নেই।
জানাজানি হয়ে গেল এই বাড়ির জমিটা কেনার সময়। জমিটা দেখে মায়ের। তো পছন্দ হয়েই ছিল, বাবারও অপছন্দ হয় নি। পাঁচ কাঠা জমি, এক লাখ তিরিশ হাজার টাকা দাম।
মা বলল, কিনে ফেলো!
বাবা বলল, কিনব কোত্থেকে, টাকা নেই।
মা অবাক। টাকা নেই মানে?
মানেটা বোঝার পর মা স্তব্ধ একেবারে। মালতী মাসি পর্যন্ত দু-তিনদিন তখন মায়ের সঙ্গে একটা কথা বলতেও সাহস করে নি।
পাঁচ-দিনের মধ্যেই শুধু মায়ের নামে এই জমি কেনা হয়েছে। তখন তো টাকার থলে নিয়ে মায়ের পিছনে লোক ঘুরছে। গোটা তিনেক ছবির আগাম বায়না নিতে সমস্যা মিটেছে। কিন্তু ঘরের সমস্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। বোকা তো মাও নয়, ওই অতবড় কারখানা চালু করতে বাবার বড় জোর লাখ দুই টাকা লেগেছে। বাকি সব টাকা সরিয়ে বাবা যে শুধু নিজের দখলে রেখেছে, সেটা বুঝতে বাকি থাকে নি। মা এরপর সমস্ত পার্টিকে জানিয়ে দিয়েছে, প্রাপ্য টাকা শুধু তার হাতেই দিতে হবে আর কাউকে নয়। কন্ট্রাক্টর এসে এই জমিতে বাড়ি তোলার কাজে হাত দিয়েছে। তখনো মা একদিনের জন্যেও বাবার সাহায্য চায় নি। বাড়িও মায়ের নামে হয়েছে।
মালতী মাসির অনুপ্রাস আর ব্যঞ্জনা স্মরণ না করেও তার পর থেকে এই সরকারবড়ির জীবন-যাত্ৰা আমি অনায়াসে কল্পনা করতে পারি।…একসঙ্গে বিশ্বাস আর টাকার ওপর দখল খুইয়ে বাবা বেপরোয়ার মতো এরপর মায়ের ওপর দখল নেবার জন্য যে মরিয়া হয়ে উঠছিল, তার নজির তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি একদিন। বাবা এই মেজাজেরই লোক। তাছাড়া যে বস্তুটার দংশনে এ-যাবৎ বহু প্রেমিক প্রেমিকার ঘর ভেঙেছে দুনিয়ায়, সেই ঈর্ষার কীট-দংশনই সর্বদাই তখন বাবার মগজেও কেটে বসছিল মনে হয়। সেই পয়সাওয়ালা ঈর্ষার মানুষ যারা, এ-বাড়িতে তাদেরও আমি অনেক দেখেছি।
আরো একটা সত্য আমার কাছে স্পষ্ট। বাবাকে মা ভয় করত। সমীহ করত না, শ্রদ্ধা করত না, শুধু ভয় করত। আর ঘৃণা করত। কত যে ঘৃণা করত, সেটা মায়ের দুচোখে উপচেও উঠত সময় সময়। কিন্তু ঘৃণার দরুন মা বাড়ি ছেডে চলে যায়নি, গেছে ভয়ে! নিজের বাড়ি, ভয় না করলে অনায়াসে বাবাকেই তো বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে পারত। আদালতে খুব সংগোপনে বাবা-মায়ের বিয়ে নাকচ হয়ে গেছে। কিন্তু এ-সব খবর গোপন থাকে না। বাবাকে ভয় না করলে এ ফয়সালাও মা এ-বাড়ির ওপর দখল রেখেই করতে পারত।
***
মা চলে যাবার পর দিনকতক এক অব্যক্ত হাহাকারের মধ্যে কাটিয়েছি আমি। নানারকম ক্ষোভের আকারে সেটা প্রকাশ পেত। দিনগত সমস্ত ব্যাপারে আমার রুদ্রমূর্তি। বাবা টের পেলে ঠাস ঠাস চড় বসিয়ে দিত গালে, তার শক্ত হাতের আঙুলের দাগ বসে যেত। মায়ের ওপর আমার রাগ, কিন্তু আরো ছেলেবেলা থেকে ওই বাবার ওপর। আমার বিদ্বেষ। :