বেগতিক দেখে মায়ের অনিচ্ছা ছিল না খুব, কিন্তু বাবার তখন মা-কে সিনেমা স্টার বানাবার ঝোঁক চেপেছে মাথায়–একবার নাম করে ফেলতে পারলে অঢেল টাকা। তখন নিজের মনের মতো একটা ইলেকট্রিক্যাল কারখানা জাঁকিয়ে তোলা জল-ভাত ব্যাপার। সেই ভবিষ্যতের আশায় ছোট যে ওয়ার্কশপটা ছিল তার মূলধন ভেঙে আর যন্ত্রপাতি বেচে কায়ক্লেশে সংসার চলছিল।
তোর মায়ের একখানা বরাত বটে, বুঝলি। সামনাসামনি দেখে খুশি না হলেও ফটো দেখে দুই-একজন সিনেমার লোক খুশি হয়েছিল। তোর বাপের মতো চোখ। ছিল তাদেরও, প্রথম ছবিতে নায়িকার থেকেও কাগজে তোর মা বেশি প্রশংসা পেয়ে গেল। দ্বিতীয় ছবিতেও তাই। তৃতীয় ছবিতে সরাসরি নায়িকা হয়ে বসল একেবারে। একচোখা ঠাকুর মুখ তুলে তাকালে ওই রকম করেই তাকায়, সেই এক ছবিতে বাজার মাৎ।
তারপর? তারপর কি জানি, লাফিয়ে লাফিয়ে ভাগ্য ফিরতে লাগল আমাদের। যে-ভাগ্য লোকে স্বপ্নে কল্পনা করে থাকে, সেই রকমই ভাগ্য। আর তলায়। তলায় দুর্ভাগ্যও সঞ্চিত হচ্ছিল কিছু, কিন্তু সেটা টাকার ঝকমকানির তলায় চাপা পড়েছিল!
মালতী মাসির প্রতি মা অকৃতজ্ঞ হয় নি। ভাগ্যের মোড় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। মালতী মাসি আমাদের দুঃখের ভাগীদার, সুখেরও। পরে মায়ের বড় হবার গতি যখন আরো দুর্বার ঊর্ধ্বমুখী, তখন ছোটখাট রোলে তাকে ঠেলে দিতে কার্পণ্য করেনি মা। কিন্তু মাসির কেন যেন আর দুপায়ে দাঁড়াবার মতো উৎসাহ বা উদ্দীপনা ছিল না। পরিতুষ্ট মুখে মাসি আমাকে বলত, সমস্ত জীবন নিজের ভাবনা ভেবেছি আর কাহাতক ভালো লাগে বল, সুখের ঘরে খেয়ে দেয়ে দিব্যি মুটিয়ে যেতে লাগলাম।
সুখের ঘর! মা এই ঘর ছেড়ে চলে যাবার পরেও মাসি সুখের ঘর বলতে পেরেছিল কি করে সেটা বিশ্লেষণ করার বয়স নয় আমার তখন। পরে মাসির বাক চাতুরীর সেতু ধরেই আমাদের সুখের ঘরের রূপটা আমি চোখ বুজে কল্পনা করতে পেরেছি।
…মায়ের সঙ্গে বাবার প্রকাশ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল আমার চার বছর বয়সের সময় থেকে। বাবা সেই জাতের মানুষ, যারা নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে উদারতার সুতোটা গড়গড় করে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে পারে। কিন্তু প্রয়োজন ফুরোলে সে সুতো গুটোবে। আমাদের সুখের ঘরে বাবার তখন ওই সুতো টোবার মেজাজ। মা চড়চড় করে খ্যাতির শিখরে উঠতে লেগেছে তখন। বছরে চার-পাঁচটা করে কন্ট্রাক্ট সই করছে। একটার থেকে আর একটার প্রাপ্তির অঙ্ক বেড়ে চলেছে। এ-সব ব্যাপারে বাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। টাকা পয়সার ব্যাপারে পার্টির ফয়সালা করতে হবে বাবার সঙ্গে। গোড়ায় গোড়ায় সঙ্কোচবশেই দেনা-পাওনার হিসেব নিকেশ মা বাবার হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু পরে এই নিয়েও খিটির-মিটির বাঁধতে লাগল। মা কারো প্রতি সদয় হয়ে বা প্রয়োজন বোধে কোথাও অল্প টাকায় কাজ করতে রাজি হলে বাবার সঙ্গে দস্তুরমতো ঝগড়া বেধে যেত। বাবার ভিতরে ভিতরে তখন নানারকম সন্দেহের কাটাছেঁড়া শুরু হত। তা ছাড়া পয়সাওয়ালা সব পার্টি বাবার এই আধিপত্য প্রীতির চোখে দেখবে কেন? লেন-দেনের ব্যাপারেও তারা অনেকে সোজাসুজি মায়ের সঙ্গেই কথা-বার্তা কইতে চাইত। মা তাতে রাজি হলেই বাবা খাপ্পা।
প্রথম দিকে বাবা প্রায় সর্বক্ষণ মায়ের সঙ্গে স্টুডিওতে থাকত। বিকেলে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরত। নিজের মস্ত ফ্যাক্টরী করার সঙ্কল্প একরকম ধামাচাপা। বাবা সঙ্গে থাকার দরুন গোড়ায় মায়ের সুবিধে হত, কিন্তু নতুন জগতের যাবতীয় কিছু বুঝে সুঝে নিতে কত আর সময় লাগে? ফলে ক্রমশ বাবার উপস্থিতি অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে লাগল। আর কিছু না হোক, আড়ালে যে বাবাকে নিয়ে পাঁচজনে পাঁচ রকমের রসিকতা করে সেও মায়ের ভালো লাগত না। স্ত্রী অভিনয় করছে আর স্বামী সাক্ষীগোপালের মতো বসে তাকে পাহারা দিচ্ছে, এ কার ভালো লাগে? লোকে আড়ালে অন্তত হাসি ঠাট্টা করবেই।
বাবাকে মা সেটা বোঝাতে চেষ্টা করেছে। বলেছে, এখন আর তোমার রোজ এত সময় নষ্ট করার দরকার কি, নিজের কাজকর্মে এবারে একটু মন দাও না।
মা এ-কথা বললেই বাবার দুচোখের চাউনি ধারালো হয়ে উঠত নাকি। টাকা পয়সা আদায়ের ব্যাপার না থাকলে নিজে থেকেই স্টুডিওয় আসা কমাতে হল তাকে। আউটডোর শুটিং এর জন্য আগে যখন দু-পাঁচ দিন বাইরে কাটাতে হত, বাবা সঙ্গে না থাকাতে মা অসহায় বোধ করত। কিন্তু মা পরে আভাসে ইঙ্গিতে বারকয়েক আপত্তি জানিয়ে শেষে সরাসরি একদিন বলে দিল, তোমার আসার দরকার নেই, এবার থেকে মালতীদিকে নিয়ে যাব।
মালতী মাসি হেসে হেসে গল্প করত, কুটকুট করে তোর বাবার সঙ্গে মা কি ঝগড়াই না করত। আর তোর বাবা ফুঁসতে থাকত।
বাইরে যাবার ব্যাপারেও হেঁটে দিতে চাওয়ার ফলে বাবা রাগত গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন, আমি সঙ্গে থাকলে তোমার অসুবিধে হয়?
একটু হয়। ঠিক মতো কাজে মন দিতে পারি না।
আগে তো পারতে?
মা জবাব দিয়েছিল, আগের অভিনয়ের মান ছাড়িয়ে যেতেই চাই। তাছাড়া নিজের কাজকর্ম ছেড়ে সবসময় স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরলে–লোকে বলে কি?
মা কথা কাটাকাটি কমই করত, কিন্তু কি চায় না চায়, সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিত।