বাবাকে ডেকে মা জানিয়ে দিয়েছে, এ বিয়ে হবে না,কারো অশান্তির কারণ সে হতে চায় না, তার জন্য কারো পরিত্যক্ত হবারও দরকার নেই।
আমার ধারণা–মায়ের আমি অবাঞ্ছিত সন্তান। অনেক পরে ধারণাটা বদ্ধমূল হয়েছে। আট-ন বছরের ছেলের কাছে মাসি হেসে হেসে গল্প করেছে, তোর বাবাকে ফিরিয়ে দেবার পর কি সঙ্কটই না গেছে তোর মায়ের। বাড়ি ছেড়ে আমার সঙ্গে আমার বস্তিঘরে এসে থেকেছে। আর তারপর আত্মহত্যা করার ফিকির খুঁজেছে। তোর মায়ের সেই চোখ-মুখ আর রকম সকম দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। একদিন এক পোঁটলা ঘুমের ওষুধ পেলাম তার বাক্স ঘেঁটে। সেই রাতেই সেগুলো নিয়ে সরকারমশাইকে দেখালাম, আর বললাম, এ বিয়ে না হলে ইন্দুমতীর বাঁচার উপায় থাকবে না। আমার মুখে সব শুনে সরকার মশাই পাথরের মতো বসে রইল খানিক। তারপর উঠে সোজা আমার বস্তিঘরে চলে এলো। মায়ের মাথায় হাত রেখে বলল, আমি তোমার ছেলে, ছেলের দোষ নিও না, আমি তোমাকে মা লক্ষ্মীর মতই আমার ঘরে নিয়ে যাব।… এর পাঁচ দিনের মধ্যে তোর বাপের সঙ্গে তোর মায়ের বিয়ে, আর বিয়ের ঠিক সাত মাসের মাথায় তুই এসে হাজির হলি।
বাবা-মায়ের বিয়ের গল্প শুনে আট-ন বছরের এক অবোধ ছেলের মালতী মাসির প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। সঙ্কটের সময় সে-ই মাকে আশ্রয় দিয়েছে, আত্মহত্যার হাত থেকে মাকে রক্ষা করেছে, মা আত্মহত্যা করলে আমার কি দশা হত, আমি কেমন করে এই পৃথিবীর মুখ দেখতাম? অবিনাশ সরকারকে বলে বাবা-মায়ের বিয়েও সে-ই ঘটিয়ে দিয়েছে, মালতী মাসির থেকে ভালো আর আপনার জন দুনিয়ায় কে আছে? কিন্তু পরে, অনেক পরে একটা চেতনার যন্ত্রণা আমার মাথায় কেটে কেটে বসেছে।… মায়ের সঙ্কটটা কি, কেন বাড়ি ছেড়ে তাকে মাসির সঙ্গে বস্তিঘরে এসে থাকতে হয়েছিল, আর কেনই বা সে আত্মহত্যার ফিকির খুঁজছিল? সবেরই একটাই। জবাব। আমি আসছিলাম বলে। আমিই মায়ের তখন সঙ্কট বলে। আমি তখন অবাঞ্ছিত বলে। আমাকে নিয়েই মায়ের যত সমস্যা।
তখন মনে হত, আমার সকলের থেকে বড় শত্রু কেউ থাকে তো সে মালতী মাসি। এই দুঃসহ অস্তিত্বটা টানতে হচ্ছে শুধু তার জন্যেই।
মাসি বলত, তোর বাবা গোঁয়ার হলে কি হবে, তার চোখ ছিল! বিয়ের আগেই মাকে বলত, থিয়েটার করে কোনদিন কিছুই হবে না, একটা সিনেমায় একবার নাম করতে পারলে টাকাও যেমন খ্যাতিও তেমনি। সিনেমায় নামতে চেষ্টা করো। তোর মায়েরও মনে মনে সেই আশা, ফিল্ম আর্টিস্ট হবে, কি করে সেটা হওয়া যায় আমার সঙ্গে সেই পরামর্শ করত… তোর মায়ের ফটো খুব সুন্দর ওঠে, সেটা তোর বাবা আগেই জানত, বিয়ের কিছুদিন পরেই ভালো স্টুডিও থেকে সে তোর মায়ের একগাদা ফটো তুলে ফেলল। কত ঢংয়ের কত রকমের ছবি সব
হ্যাঁ, সেই ছেলেবয়সে মা-খোয়ানোর ক্ষত বুকে চেপে সেই সব ছবি আমি নিজের। চোখেই দেখেছি। বাবার কাছ থেকে চাবি সরিয়ে, মায়ের দেরাজ বা আলমারি থেকে সব জিনিসপত্র টেনে বার করে তছনছ করে ফেললে কে নিষেধ করবে, কে ধমক লাগাবে? ওই করতে গিয়েই দেরাজ থেকে মায়ের দু-তিনটে ফটো অ্যালবাম বেরিয়েছে। এই অ্যালবাম আমার আগেও চোখে পড়েছে কিন্তু মা কখনো সে-সব নেড়েচেড়ে দেখতে দেয় নি।
শিশুমনের এক জমাট বাঁধা আক্রোশ নিয়ে সে-সব খুলে বসতাম। কিন্তু কখন। যে মা-কে দেখার মধ্যেই তন্ময় হয়ে যেতাম, টের পেতাম না। মা যে কত সুন্দর সেটা যেন আগে দেখি নি, আগে বুঝি নি। বাড়িতে এই মায়েরই হাসিমুখ দেখেছি, গম্ভীর মুখ দেখেছি, সুন্দর ভ্রূকুটিও দেখেছি, তবু ছবিতে ওই সব দেখে মনে হত, এমন আর কখনো দেখি নি।
এই সব ছবি বাছাই করে বাবা নাকি সিনেমার কর্তাদের কাছে পাঠিয়ে দিত! ছবির সঙ্গে মায়ের পরিচয় থাকত। অল্পস্বল্প নাম তো থিয়েটারের জন্যই হয়েছিল, তাই ছবি দেখে ওই ছবিওয়ালাদের কারো কারো আগ্রহ হল।
হলে কি হবে, সেই গোড়া থেকে তুই সোজা জ্বালিয়েছিস তোর মাকে। মালতী মাসি বলত, ও-সময় চেষ্টা করার জন্য তোর বাবার সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে গেছে, তোর মা কারো সঙ্গে তখন দেখা করতেই রাজি নয়।
অর্থাৎ আমি আসছি সেটাই অন্তরায় তখন।
অ্যালবাম থেকে মায়ের ফটোগুলো খুলে সামনে ছড়িয়ে রাখতাম, আর ভাবতে চেষ্টা করতাম, মা কোথাও যায় নি, নানান মূর্তিতে আমার সামনেই আছে। ভাবতে না পারলে বলতাম, আমি আসার পরে আর তো তোমাকে বেশি জ্বালাতন করি নি, বিরক্ত করি নি। আগে যা হয়েছে তার জন্যে আমার কি দোষ? তুমি আমাকে ফেলে গেলে কেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে না কেন? আমি মা ছাড়া থাকতে পারি না, জানো না? তুমি ছেলেকে ছেড়ে থাকতে পারছ কি করে?
আমি জন্মাবার ছমাস বাদে বাবা আর মা একসঙ্গে আবার ছবির জগতে না দিয়েছে। মালতী মাসি বলে, সংসার তখন প্রায় অচল তোদের, তোর জন্য ঠিক একটু দুধ জোটানও শক্ত হয়ে উঠছিল।
এমন দুরবস্থায় পড়ার কারণ, দাদু অর্থাৎ বাবার বাবা সরকার মশাই হঠাৎ চোখ বুজেছে। তারপরেই ভাইদের মধ্যে অশান্তি। ছোট দুই ভাই বলেছে, দশ হাজার টাকা দিয়ে বাবা তাকে আলাদা ওয়ার্কশপ করে দিয়েছে অতএব ডেকোরেটিং-এর ব্যবসায়। তার কোনো ভাগ নেই। বাবা ভয়ঙ্কর জেদী আর একরোখা মানুষ–ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া করে মা-কে নিয়ে আর আমাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েই চলে এসেছে। তখন সস্তাগণ্ডার দিন, তাই পঞ্চাশ টাকায় দুটো ঘর ভাড়া পাওয়া গেছল। কিন্তু সেই পঞ্চাশ টাকাই বা আসে কোথা থেকে? মালতী মাসির অবশ্য খুব ইচ্ছে ছিল, মা আর মাসি দুজনে মিলে সরকার মশাইয়ের থিয়েটারটা চালায়। থিয়েটার একেবারে বন্ধ হবার ফলে তারও তো চরম দুরবস্থা তখন।