মায়ের মুখে সে সংসারের দুরবস্থার কথা শুনল, আর মা যে স্কুলের নাটকে অভিনয় করে দু-তিন বার মেডেল পেয়েছে, তাও জানল।
সেই থেকে মায়ের অভিনয়-জীবন শুরু। আর তার সায়াহ্নে আবার সেই মঞ্চেই পদার্পণ। খবরের কাগজে এই যোগাযোগের খবরও ফলাও করে ছাপা হয়েছিল।
মালতী মাসি বলত, পাড়ার এক বস্তিতে থাকতুম, তোর মায়ের সঙ্গে আগে থেকেই একটু ভাব-সাব ছিল। আমার কাছ থেকে ভরসা পেয়েই অবিনাশ সরকারের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিল। আর তোর মা এসে ছমাসের মধ্যেই কিনা আমার জায়গাটি জুড়ে বসল! শুধু তাই, আপিস বা ক্লাব থেকে প্লে করার জন্যও আমার বদলে তোর মায়ের ডাক পড়তে লাগল। উপকার করতে গিয়ে আমি শেষে উপোস করে মরি আর কি!
বছর খানেকের মধ্যে শৌখিন নাটক মহলে মায়ের বেশ নাম হয়ে গেছল। নানা জায়গা থেকে ডাক আসত, আর টাকা-কড়িও বেশ পেত। অবিনাশ প্রকারের ক্লাবও তখন মায়ের দৌলতেই বেশ কেঁপে উঠেছিল। সেই কারণে মায়ের প্রতি সরকার মশাইয়ের স্নেহ ভালবাসাও দিন দিন বাড়ছিল। মায়ের বেশ কড়া গার্জেন হয়ে উঠেছিল সে। শহরের বাইরে থেকে অথবা বেশি দূরের কোনো অনুষ্ঠার্নে অভিনয়ের ডাক এলে বেশি টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও ভদ্রলোক যাবার অনুমতি দিত না। শহরের মধ্যে হলেও মাকে একলা ছাড়ত না, হতে সময় থাকলে নিজে সঙ্গে যেত, নয়তো বেশির ভাগ সময় নিজের অনেক দিনের বিশ্বস্ত চাকর হীরা সিংকে সঙ্গে দিত। সরকার মশাইয়ের অনুমতি ভিন্ন মায়ের কোথাও অভিনয় করার উপায় ছিল না। শুনেছি, ওই বুড়ো হীরা সিংও মাকে ভালবাসত খুব। কোথাও গেলে মাকে চোখে চোখে রাখত।
কিন্তু ওই হীরা সিংকে অবিনাশ সরকার চাবুক্ নিয়ে তাড়া করেছিল একদিন। কারণ, সেদিন সে জেনেছে, হীরা সিং তার সঙ্গেই সব থেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার ছেলের সঙ্গে মায়ের ভাব-সাবের ব্যাপারটা অনেক দিন পর্যন্ত সকলের চোখে গোপন ছিল তার জন্যেই। বাবুর ছেলে যে নিজের কাজকর্ম ফেলে মায়ের প্রত্যেকটা নাটক দেখতে ছোটে, আর ফেরার সময়ে বাসে যাবার জন্য ওর হাতে দু-পাঁচ টাকা গুঁজে দিয়ে মাকে নিয়ে ট্যাক্সি করে ফেরে–সেটা একমাত্র ও ছাড়া আর কে জানত?
অবিনাশ সরকারের ছেলে বিজন সরকার, সেই আমার বাবা।–
নাট্যরসিক অবিনাশ সরকারের নিজের ছিল পৈতৃক আমলের ডেকরেটিংয়ের চালু ব্যবসা। নিজের আমলে সেই ব্যবসা সে আরো অনেক বড় করে তুলেছিল। এই ব্যবসায় তাদের নাম ছিল। তার অন্য দুই ছেলে, পের ব্যবসায় যোগ দিয়েছিল, কিন্তু বড় ছেলে বিজন সরকার উৎসবে অনুষ্ঠানে অন্য লোকের ঘর বাড়ি সাজানো বা পেয়ালা প্লেট আর খাওয়া-দাওয়ার বাসন সরবরাহ করাটাকে সম্মানজনক ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে নি। সে লেখাপড়া শিখে ইলেকট্রিক্যাল এনজিনিয়ার হয়েছে। কিন্তু বংশের কেউ চাকরি করায় অভ্যস্ত নয়, বিজন সরকারও কোনো চাকরিতে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে নি।
তার স্বপ্ন লাখ দেড় দুই টাকা পেলে মস্ত একটা ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কশপ খুলে বসবে। দিশি বিলেতি যন্ত্রপাতি সাজ সরঞ্জাম থাকবে, অনেক লোকজন কাজ করবে, ব্যবসা কাকে বলে বাবাকে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু অনেক টানা হ্যাঁচড়ার পর ভদ্রলোক ছেলের হাতে মাত্র দশটি হাজার টাকা গুনে দিয়ে বলেছিল, এই দিয়ে যা পার করো, এর বেশি আর এক কপর্দকও দেবার ক্ষমতা নেই।
সেই দশ হাজার টাকায় বিজন সরকার যে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল, তার নিজের চোখেই সেটা একটা খেলনার মতো। এই হতাশার দরুন তার মেজাজ-পত্র ভালো ছিল না কোন দিন। আর ওই ক্ষোভের দরুন বাড়ির কারো সঙ্গে তেমন বনিবনাও ছিল না।
সেই ছেলে এমন একটা কাণ্ড করে বসতে পারে, অবিনাশ সরকারের কল্পনার বাইরে। কারণ নিজের ক্লারে কোনো অনুষ্ঠানে ছেলেকে কোনদিন দর্শকের আসনে এসে বসতেও দেখেনি। সেই ছেলে যখন আচমকা ঘোষণা করে বসল, মা-কে বিয়ে করবে, ভদ্রলোক স্তম্ভিত। ছেলের উপার্জন কি জানে না, অতএব সঙ্কল্প শুনে তার তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া ভদ্রলোক যত বড় নাট্যকারই হোক, আর মায়ের কল্যাণে তার সংস্থাটির আয় পয় বেড়েছে বলে তাকে যত স্নেহই করুক, পাঁচ জায়গায় থিয়েটার করে পাঁচজনের প্রেমিকা সেজে টাকা রোজগার করে যে মেয়ে, তাকে একেবারে ঘরে বউ করে আনার প্রস্তাবটা সে ভাবতেও পারে না হীরা সিংকে ডেকে জেরা করতে ব্যাপার কি করে এত দূর গড়ালো সেটা ফঁস হয়ে গেল। তাকে ধরে মারতে বাকি রাখল প্রথম। বেচারা হীরা সিংয়ের দোষ কি, সে জানে, দাদাবাবু যখন বিয়েই করবে দিদিমণিকে, তখন আগে থেকে এক আধটু মেলামেশা করলে কি আর এমন দোষ? এতকাল কলকাতায় থেকে কম তে দেখল না।
অবিনাশ সরকার ছেলেকে ডেকে জবাব দিল, বউ নিয়ে অন্যত্র বাস করার মুরো থাকলে বিয়ে করতে পারে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
ছেলেও গোঁয়ার। তেমনি পাল্টা জবাব দিল, ঠিক আছে।
কিন্তু এই পর্যায়ে বেঁকে বসল আমার মা। সরকার মশাই পিতৃতুল্য তার, অসময়ে আশ্রয় দিয়েছে, সামান্য হলেও একলার চলে যাওয়ার মতো রোজগারের রাস্তা খুলে দিয়েছে। মায়ের আশা ছিল, সরকার মশাই প্রস্তাব শুনে খুশি হবে, তার ছেলেও সেই রকম আশ্বাসই দিয়েছিল। তার উগ্র মূর্তি দেখে মা হতভম্ব। মায়ের সঙ্গেও ভদ্রলোক যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করেছে। সকলের সামনে অকৃতজ্ঞ বলে গালাগাল করেছে।