মালতী মাসির মুখে যা শুনেছি, নিজের চোখে যেটুকু দেখেছি, আর যা দেখি নি বা শুনি নি অথচ সম্ভাব্য সত্য বলে আমার কল্পনায় এসেছে–সেই সবকিছু মিলিয়ে এই সরকার বাড়ির জীবন-যাত্রার একটা চিত্র আমার চোখের সামনে স্থির হয়ে আছে। আমি এর ওপর কোনো মন্তব্য করিনে, করতে চাইনে–নির্লিপ্ত দর্শকের মতো সেটা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি।
মা আমার চোখে দুনিয়ার সেরা রূপসী বটে (এখনো কি?), কিন্তু মাসির মতে রূপের বাজারে ওই রূপের দাম নেই কিছু। গায়ের রং তো কালোই বলতে হবে। ঘষে-মেজে যেটুকু দাঁড়িয়েছে তাকেও ফর্সা বললে রীতিমতো অত্যুক্তি হবে। আর নাক-চোখ-মুখেরও এমন কিছু বাড়তি বৈশিষ্ট্য নেই যা নিখাদ রূপের পর্যায়ে পড়তে পারে। মাথার চুলও কাধ পিঠের আধাআধি নামে নি। তবে লম্বাটে গড়ন, স্বাস্থ্য ভালো, আর হাসলে ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখলে মনে হয় যেন নিখুঁতভাবে সাজিয়ে বসানো।
মাসির মতে মা চিরঋণী ক্যামেরা নামে যন্ত্রটার কাছে। অমন ক্যামেরামুখো ভাগ্য সচরাচর নাকি কারো হয় না। ওই যন্ত্রটাই মাকে রূপের ছাড়পত্র দিয়েছে। যখন। যে-ভাবে যে-ঢঙে ছবি তুলুক, তাই চোখে পড়ার মতো সুন্দর। ওই যন্ত্রটার কল্যাণেই মা প্রায় দুযুগ ধরে তার স্তাবক আর অনুরাগীদের চোখে অনন্যার আসনে বসে থাকতে পেরেছে। তবে মায়ের দুটো গুণের কথাও মালতী মাসি একবাক্যে স্বীকার করেছে। এক, চোখের ভাষা। তা এত নীরব অথচ এত স্বচ্ছ, গভীর আর স্পষ্ট যে, সেটাই নাকি মায়ের বিশেষ একটা রূপ। দুই, জোরালো আলো আর ক্যামেরার সামনেও খুব সহজ আর স্থির থাকতে পারার গুণ। ওই জন্যেই মায়ের অভিনয় কোনো সময় অভিনয়। বলে মনে হয় না।
কিন্তু এই সব গুণের কদর হয়েছে ঢের পরে। অনেক হতাশার দিন গেছে। মায়েরা ছিল পাঁচ বোন আর তিন ভাই। মা সকলের ছোট। দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবা ছিল মার্চেন্ট অফিসের নিচের দিকের কেরাণী। যে মাইনে পেত তাতে মাসের বিশ দিনও টেনে-টুনে চলত না। তাই মাসিরা আর মামারা অল্প বয়স থেকেই যে-যার ভবিষ্যতের রাস্তা নিজেরাই বেছে নিয়েছে। মামাদের মধ্যে বড়জন স্কুলের মাষ্টার, দ্বিতীয়জন ইনসিওরেন্সের দালালী করতে করতে একবার এক শাসালো পার্টির মোটা টাকা মেরে অনেক দিন জেলখাটার পর ফেরারী হয়েছে। এখন কোথায় আছে বা কি করছে, কেউ জানে না। ছোট মামা দেব্রতী হিসেবে কিছু নাম করেছে। নরম গরম লেকচার দিয়ে বেড়ায়, গোটাকতক ইউনিয়নের পাণ্ডাগিরি করে, চাকরি বাকরি করেনি কোনদিন অথচ বিয়ে থা করেছে, ছেলে-পুলে আছে–আর তার অবস্থাই মোটামুটি সচ্ছল একটু।
ওদিকে মাসিরাও অল্প বয়স থেকেই যে যার নিজের নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে চেষ্টা করেছে। বড় মাসি কলেজে পড়তে পড়তে এক পয়সাওয়ালা মাড়োয়ারী ছেলের ঘরণী হয়ে বসেছে। মেজ মাসিও সেই গোছের কিছু চেষ্টা করতে গিয়ে কোথায় ভেসে গেছে, কেউ জানে না। নমাসি আর ছোট মাসি অন্য বোনেদের তুলনায়ও কুচ্ছিৎ দেখতে। তাদের একজন প্রাইমারি মেয়ে স্কুলের মাষ্টার, অন্যজনের ধর্মে মতি। সে। নামকরা সেবায়তনের দীক্ষিত কর্মী। তার মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, গেরুয়া ধুতি পরা, বাস্তব চাওয়া-পাওয়ার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন।
সকলের ছোট মা, রুচির দিক থেকে তার বাবার ধাত পেয়েছিল। দাদু নাকি অ্যামেচার পার্টি আর আপিসের বাৎসরিক নাট্যানুষ্ঠানের নামকরা কমিক অভিনেতা ছিল। আপিসের সামান্য কেরানী বাপ হওয়ার বাস্তব কমিকটা ভোলার জন্যেই অভিনয়ের এই অঙ্গটি আঁকড়ে ধরেছিল কিনা কেউ বলতে পারবে না। মা যেৰূরে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিল, সেবারে আট ছেলে মেয়ের বাপ ওই ধরনের কমিক অভিনেতার মৃত্যুর খবর আর ছবি কাগজেও ব্রেরিয়েছিল, শুনেছি।
দাদু মারা যাওয়ার পর তার বিধ্বস্ত সংসারের হালছাড়া দশা। স্কুল-মাষ্টার বড় মামা তার বাপের আমলেই পৃথক হয়ে গেছল। দেশব্রতী ছোট মামার ভগ্নদশা বীর হাল ধরার আগ্রহ আগেও ছিল না, পরে সে আরো উদাসীন। বড় মাসি কিছু কিছু সাহায্য করত, আর ভরসা ন মাসির প্রাইমারি স্কুলের সামান্য বেতন। তারও আনকোরা নতুন চাকরি তখন। তাদের মায়ের অর্থাৎ আমার দিদিমার বুকের ব্যামো লেগেই ছিল। কিন্তু বড় মাসির করুণা না হলে সময়ে একটু ওষুধও জুটত না।
টেনেটুনে স্কুল ফাইনাল পাশ করে মা প্রায় দুবছর ঘরে বসে ছিল। ন মাসি তখন তার জন্যও স্কুলে চাকরির চেষ্টা করেছে, আর বোনের নিজের গরজের অভাব। দেখে বকাবকি করেছে। ন মাসি চাকরি জুটিয়ে দিতে পারলে মা সেই চাকরি করত হয়তো কিন্তু আসলে ওই চাকরি মায়ের দুচোখের বিষ।
সংসার যখন একেবারে অচলপ্রায় মা তখন হঠাৎ একদিন সাহসে কোমর বেঁধে পাড়ার অবিনাশ সরকারের সঙ্গে দেখা করতে গেল। এখানকার অ্যামেচার নাটকের সংস্থাটি তারই হাতে গড়া। মায়ের বাবা এই সংস্থারই পাকাঁপোক্ত কমিক অভিনেতা ছিল, আর ওই ভদ্রলোক তখন সামান্য করণিক বলে দাদুকে অবজ্ঞা করত না, বরং ভালোবাসত। অ্যামেচার ক্লাব হলেও কোনো সামান্য অবস্থার শিল্পী কিছু কিছু টাকা পেত, বিশেষ করে মেয়ে শিল্পীরা। বিনা টাকায় মেয়ে-শিল্পী সংগ্রহ করা খুব সহজ হত না। মালতী মাসি তখন ওই ক্লাবের সুবেতন শিল্পী একজন। তার বাড়ি ঘরের। পরিচয় আজও আমার জানা নেই। অবিনাশ সরকার এমনিতে রুক্ষ মেজাজী মানুষ, কিন্তু ভিতরটা দরদী। মা জানত, দরকারের সময় ভদ্রলোক বাবাকে অনেকভাবে সাহায্য করত।