মশারির ভিতর দিয়ে দেখি মায়ের জায়গায় মালতী মাসি কাঠ হয়ে শুয়ে আছে। আর সভয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে।
আমার ধারণা মালতী মাসি আমাকে তো ভালোবাসেই আমিও মালতী মাসিকে কম ভালোবাসি না। কিন্তু সেই রাতে সাত বছরের এক শিশুর মাথার মধ্যে কি যে আগুন জ্বলে উঠেছিল কেউ কল্পনা করতে পারবে না। দুহাতে মশারিটা টেনে একেবারে। ছিঁড়েই নিয়ে এলাম আমি।
তুমি এখানে কেন? কে তোমাকে মায়ের জায়গায় এসে শুতে বলেছে? বেরিয়ে যাও বেরিয়ে যাও বলছি এ-ঘর থেকে!
মালতী মাসি শশব্যস্তে উঠে বসে দুহাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে চেষ্টা করল।–সুমু লক্ষ্মী বাবা, এত রাতে এ-ভাবে চিৎকার করতে নেই, আয় ঘুমুবি আয়।
না না, আমি ঘুমুব না, রাগে কাঁপতে কাঁপতে আরো ডবল চিৎকার করে উঠলাম। আমি।–তুমি চলে যাও, তুমি আমার মায়ের জায়গায় কেন শুয়েছ? আমার মা কোথায়?
মালতী মাসি সভয়ে সামনের বন্ধ দরজার দিকে তাকালো একবার, তারপর খাট থেকে নেমে আমাকে ধরার জন্য এগিয়ে এসে বলল, লক্ষ্মী মাণিক, শুবি আয়, মা নিশ্চয় কোথাও শুটিং-এ গেছে, সকালেই ঠিক ফিরবে দেখিস
আমি তিন পা পিছিয়ে গিয়ে তেমনি ক্ষিপ্ত রোষে চিৎকার করে উঠলাম, মিথ্যে কথা, তুমি মিথ্যেবাদী। মা কক্ষণো শুটিং-এ যায়নি, আমাকে না বলে মা কক্ষণো শুটিং-এ যায় না, তুমি চলে যাও এ-ঘর থেকে, আমার কাউকে দরকার নেই, কাউকে চাই না আমি!
বন্ধ দরজার ও-দিকে একটা শব্দ হতে দুজনেই সেদিকে থমকে তাকালাম। দুঘরের মাঝের বন্ধ দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল। দরজাটা এদিক থেকে বন্ধ থাকে–কখন কে খুলে রেখেছে জানি না। ও-ঘরের অন্ধকার থেকে বাবা এ-ঘরে এসে দাঁড়াল। বোতলের ওই সব জিনিস খেলে বাবা খুব ঘুমোয় দেখেছি, কিন্তু আজ বাবার দুচোখ লাল! আমার চিৎকারে ঘুম ভাঙা স্বাভাবিক, কিন্তু লাল চোখ দেখে। মনে হল বাবাও অত রাত পর্যন্ত জেগেই আছে।
ঘরের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে এসে প্রথমে বিছানার ওপর ছেঁড়া-খোঁড়া মশারিটার দিকে তাকালো, তারপর আমার দিকে ফিরতে গিয়ে আগে মালতী মাসির দিকে চোখ গেল। বাবাকে দেখামাত্র শুধু যে আগুনের ওপর ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা পড়েছে তাই নয়, চোখাচোখি হতে মাসিও হকচকিয়ে গেল কেমন। মাসির গায়ে জামা ছিল না, মনে হল ঘাবড়ে গিয়ে মাসি শাড়ির আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়াতে লাগল।
বাবা এবার আমার দিকে ফিরল, কি হয়েছে?
আমি নির্বাক।
মশারিটা ওভাবে ছিঁড়ল কি করে? আর রাত করে এত চেঁচামিচি কিসের?
আমি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইলাম। রাগে বাবার ফর্সা মুখ লাল হচ্ছে। মাসি ভয়ে ভয়ে বলল, মায়ের জন্যে কান্নাকাটি করছে
বাবা আবার তার দিকে তাকাতে মালতী মাসি আবার থতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
আঙুল তুলে বিছানা দেখিয়ে বাবা হুকুম করল, গো টু বেড!
আমি গোঁ ধরে দাঁড়িয়েই রইলাম। বাবা এবার হুঙ্কার দিয়ে উঠল, গো টু বেড়! ফের যদি এরকম বাঁদরামো আর চেঁচামিচি করতে দেখি তো চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব।
আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। রাগে সমস্ত শরীর কাঁপছে। কিন্তু বাবা তক্ষুনি ঘর ছেড়ে চলে গেল না দেখে আমি শুয়ে শুয়েই ঘাড় ফেরালাম একটু।… বাবা কি এবার মাসিকে বকবে নাকি! অমন করে চেয়ে আছে কেন? চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাসির মাথা থেকে পা পর্যন্ত বার দুই তিন তাকালো বাবা। না, বাবার এই চাউনিটা একটু আগের মতো রাগে ভরাট নয়, কেমন যেন ঘোলাটে ঘোলাটে। আর তাইতেই মাসি হঠাৎ যেন একেবারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নিজের অন্ধকার ঘরের দিকে ফিরে যেতে যেতে বাবা বলল, ও ঘুমোক, তুমি– শুনে যেও তো একটু কথা আছে।
আমি তারপরেও অবাক চোখে কিছুক্ষণ মালতী মাসিকে দেখলাম। না, বাবার গলার স্বরে আর রাগের লেশমাত্র নেই, তবু মাসি হঠাৎ এমন কাঠ হয়ে গেল কেন ভেবে পেলাম না। আমি এই রকম বেয়াদপি করেছি বলে বাবা নিশ্চয় মাসিকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বকাবকি করবে না! জাতি।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওঘরে মৃদু গম্ভীর গলা খাঁকারির শব্দ কানে আসতে মাসির যেন হুস ফিরল। চমকেই উঠল একবার। তারপর আমার দিকে তাকালো। বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। মাসির এই মূর্তি দেখে আমার যেন মায়া হল একটু।
ঘরের আলোটা জ্বেলে রেখেই মাসি আস্তে আস্তে বাবার অন্ধকার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
আমি লাফ দিয়ে উঠে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
তখন বুঝিনি, এর ঢের ঢের পরে বুঝেছি মালতী মাসি আলো থেকে কোন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেল।
এরপর একটানা আরো ছবছর মালতী মাসির সঙ্গে এ-বাড়িতে কাটিয়েছি। তার মধ্যে সাড়ে পাঁচ বছর ধরেই আমার মনে হয়েছে মাসি যেন সেই এক রাতের পর থেকে রাতারাতি অনেক বদলে গেছে। সে আমাকে আগের থেকে আরো বেশি ভালোবেসেছে। দিনের পর দিন মায়ের কত গল্প করেছে ঠিক নেই। কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছে, যে মা আর এলোই না এ-বাড়িতে শুধু তার ওপরেই যেন মাসির সে-রকম দরদ নেই।
***
মায়ের গল্প বলতে মালতী মাসি খুব সাধারণ আর্টিস্ট থেকে এত বড় অভিনেত্রী হয়ে ওঠার গল্পই বেশি করত। শুনতে ভালো লাগত, কিন্তু মাসির অনেক কথার তাৎপর্য আর ইংগিত বোধগম্য হত না। আমি বুঝি বা না বুঝি সে যেন অনেকটা নিজের বলার ঝোঁকে বলে যেত। বুদ্ধি বিবেচনা একটু পরিণত হয়ে উঠতে কিছুই আর অস্পষ্ট ছিল না অবশ্য, কিন্তু মাসি ততোদিনে আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ভবিষ্যতের পথ ধরেছে।