গাড়ির হর্ণ বেজে উঠতে একটা জমাট বাঁধা রাগ নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে। আমি মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালাম। মা যেন শক্ত একখানা পাথরের মতো বিছানায়। বসে।
দুবছর হল আমার এই শাস্তি অর্থাৎ স্কুল শুরু হয়েছে। আর এই দুবছর ধরেই গাড়িতে ওঠার আগে আমি মাকে আদর করি আর মা আমাকে আদর করে। একদিনও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা-ও আমার দিকে চেয়ে আছে। কালকের মতো না হলেও এই চাউনিতেও যেন একটুও দরদ নেই। আমি গিয়ে আদর করলেও মা আমাকে ফিরে আদর করবে কিনা সন্দেহ।
রাগ আর অভিমান বুঝি একসঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আমার। এক ঝটকায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে দুপদাপ পা ফেলে আমি নীচে নেমে চলে এলাম। গাড়িতে এসে উঠে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করলাম। কিন্তু গো সত্ত্বেও দোতলার বারান্দার দিকে একবার না তাকিয়ে পারা গেল না। গাড়ি চোখের আড়াল হবার আগে মা ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে।
. আজ আর ওখানে দাঁড়াবেও না ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু না, দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমি সরোষে ঘাড় ফিরিয়ে নিলাম।
স্কুল থেকে ফিরে মা-কে বাড়িতে দেখব না জানা কথাই। বলতে গেলে রোজই শুটিং থাকে। ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ বাড়ি ফেরে। তবু গাড়ি থেকে নেমে সমস্ত বাড়িটা একবার ঘুরে দেখে নিলাম। চাকর-বাকর দুটো ঘুমুচ্ছে, মালতী মাসিও ঘুমুচ্ছে।
বিকেল পর্যন্ত একটা অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়ে দিয়ে মায়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাগ আর অভিমানের থেকেও ভিতরে ভিতরে আমার অজানা। ভয়টাই যেন বেশি। কাল রাত থেকে যে-মুখ দেখেছি মায়ের অমন আর কখনো দেখি নি।
বিকেলে বাবা ফিরল। তখন পর্যন্তও তার গম্ভীর আর নির্দয় মুখ। খেলাধুলো ছেড়ে আমি ঘরে বসে আছি দেখে একবার সামনে এসেছিল। আমি ঘৃণায় তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। গতকালের জন্য নয়, বাবাকে আমি কোনদিনই বিশেষ পছন্দ করি না।
তোর পায়ে কি হয়েছে?
কেটে গেছে।
কি করে কাটল?
কাল রাতে তুমি বোতল আছড়ে ভেঙ্গেছিলে, সেই কাঁচে।
বাবা ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল। মুখের ওপর কিছু বলা গেল ভেবে আমি মনে মনে একটু খুশি হলাম।
বিকেল গেল, সন্ধ্যা পার হল, রাত বাড়তে থাকল–মায়ের দেখা নেই। সন্ধ্যার পরে আমার একবর্ণও পড়া হল না। অস্থির হয়ে আমি এ-ঘর ও-ঘর করতে লাগলাম। স্টুডিওতে ফোন করার জন্য তিন বার করে আমি মালতী মাসিকে তাগিদ দিতে সে বিরক্ত হয়ে বলল, তোর মা কি এখনো স্টুডিওতে বসে আছে নাকি!
যত সময় যাচ্ছে, আমার বুকের ভিতরে যেন একটা কাঁপুনি ধরছে। কেবলই মনে হচ্ছে মা যদি আর না-ই আসে? মায়ের যে রকম ভয়াবহ চোখ মুখ দেখেছি। কাল রাত থেকে, সবই যেন সম্ভব। ওই সম্ভাবনার চিন্তাটাকে যতবার আমি নির্মূল করতে চাইলাম ভিতর থেকে ততো যেন ওটা বুকের ওপর চেপে বসছে। শেষে। আর থাকতে না পেরে বাবার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাবা অনেকক্ষণ পর্যন্ত লক্ষ্য করল না আমাকে, গেলাসে ওই বোতলের জিনিস ঢেলে খাচ্ছে আর সিগারেট টানছে।
মা এখনো বাড়ি ফেরে নি।
নিজের গলার স্বর কানে আসতে নিজেই যেন অপ্রস্তুত আমি। হঠাৎ যেন একটা– ঝঝ বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।
বাবা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। ঠিক যেন বুঝে উঠল না কি বলছি। –ভিতরে আয়।
কয়েক পা এগোতে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে আসতে দাঁড়িয়ে গেলাম।
কি হয়েছে?
মা এখনো ফেরে নি।
বাবা আমার দিকে চেয়েই রইল, তার মুখটা যেন হিংস্র হয়ে উঠতে লাগল।–ফেরে নি তো আমি কি করব?
আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
গেট আউট!
চলে এলাম। মনে হল, অবাধ্য হলে বাবা আমাকেও বোতল ছুঁড়ে মারতে পারে।
মালতী মাসি টিকটিক করতে থাকল বলেই খেয়ে নিলাম। নইলে মাকে আক্কেল দেবার জন্যেই খাবার ইচ্ছে ছিল না। এক সময় শুয়ে পড়লাম। মালতী মাসি আমাকে। গল্প বলে ঘুম পাড়াতে এলো। রাগ করে আমি অন্য দিকে ফিরে শুয়ে রইলাম।
মালতী মাসি আর আমার কাছে ঘেঁষতে সাহস করল না। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। আমার সমস্ত জমাট বাঁধা রাগ আর অসহিষ্ণুতা আর ভয়। জল হয়ে চোখ বেয়ে গড়াতে লাগল। সেই জলে বালিশ ভিজছে। আমি মনে মনে কেবল বলছি, মা তুমি শীগগির চলে এসো, আমি তোমার খুব ভালো ছেলে হব, আর কক্ষনো তোমাকে বিরক্ত করব না, আর বড় হয়ে বাবাকে খুব শাস্তি দেব।
…রাত কত তখন জানি না। মনে হয় মাঝ রাত্রি হবে। হঠাৎ ঘুম ভাঙতে অন্ধকারে বিষম চমকে উঠলাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে তার জায়গায় শুয়ে আছে। আমি চমকে উঠতে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে থাকল আমাকে।
আমিও তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে অভিমানহীন স্বরে বলে উঠলাম, অত রাত পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে, সমস্তক্ষণ আমি কষ্ট পেয়েছি জানো না।
মা আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে গালে মুখে চুমু খেল। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো একটা ঝাঁকুনি খেলাম আমি।
স্নেহের ওই উষ্ণতাকে কেমন অপরিচিত মনে হল আমার। মায়ের গায়ের চেনা। গন্ধও নাকে আসছে না।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি। ঘরটা আজ অন্য দিনের তুলনায় বেশি অন্ধকার। ওদিকের দুটো জানলাই বন্ধ বোধহয়। অন্ধকার কুঁড়ে দেখতে চেষ্টা করলাম কে শুয়ে আছে। ঠিক বোঝা গেল না। চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেছে, একটা তপ্ত আক্রোশ যেন মাথার দিকে ধাওয়া করেছে। মশারিটা হ্যাঁচকা টানের চোটে ছিঁড়েই গেল বোধ হয়। আমি ছিটকে বেরিয়ে এসে খট করে আলো জ্বালোম।