ইস, কি সর্বনাশ! করেছিস কী! তাড়াতাড়ি কাটা পাটা নিজের হাঁটুর ওপর তুলে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, কতটা জখম হয়েছে। রক্তাক্ত চাদরটার দিকেও তাকালো একবার।
আমি বলে উঠলাম, মাসি, বাবা মা-কে হিঁচড়ে টেনে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল, এতক্ষণে মেরেই ফেলল বোধহয়, তুমি শীগগির গিয়ে দেখো!
মাসি থমকে তাকালো আমার দিকে। আমার উদ্বেগ আর ত্রাস দুই-ই অনুভব করল বোধহয়। কিন্তু অবাক। এতবড় সংবাদ শুনেও মাসি নির্বিকার, মায়ের কাছে ছুটে বার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। উল্টে আমার ভয় দেখে তার ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির মতো দেখা গেল কিনা ঠিক বুঝলাম না।
বিছানায় রক্ত না লাগে এই ভাবে পাটা নামিয়ে রেখে মাসি ঘরের দুরবস্থাটা। আর এক প্রস্থ দেখে নিল।
তারপর চটপট বেরিয়ে গিয়ে একটা ঝটা আর জলের বালতি হাতে ফিরে এলো তক্ষুনি। আগে ঘরটা ঝাট দিয়ে ভাঙা কাঁচগুলো সব এক কোণে জড় করতে লাগল।
তাই দেখে আমার রাগ হয়ে গেল, বলে উঠলাম, তুমি যাচ্ছ না কেন? মায়ের কি হাল দেখে আসছ না কেন?
দ্রুত ঘর ঝাট দিতে দিতে মাসি জবাব দিল, তোর মায়ের কিছু হয় নি।
হয়েছে, নিশ্চয় হয়েছে! তুমি দেখো নি বাবা কিভাবে মাকে টেনে নিয়ে গেল। মা এখনো আসছে না কেন? বাবা নিশ্চয় মেরে ফেলেছে
না রে না, আদর-টাদর করছে বোধহয়।
মাসির মুখ দেখা যাচ্ছে না, শব্দ না করে খুব তাড়াতাড়ি ঘর ঝাট দেওয়া শেষ করছে! এত বড় সঙ্কটের মুখে এ-কথা শুনে আমি তাজ্জব। বাবা মাকে আদর করতে পারে এমন অসম্ভব কথাও আর যেন শুনি নি।
ঘর ঝাট দেওয়া শেষ করে ভাঙা কাঁচের স্তূপ এককোণে জমিয়ে রাখল। তারপর তেমনি চটপট হাতে বালতির ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে সমস্ত মেঝেটা মুছে ফেলল। নইলে। কাঁচের কুচি পড়ে থাকতে পারে। শেষে জল-ন্যাতার বালতি বাইরে বার করে দিয়ে তুলো আর ডেটলের শিশি হাতে আমার সামনে মোড়া টেনে বসল।
শুশ্রূষা শুরু হবার আগেই আমি চমকে ফিরে তাকালাম। মা নিঃশব্দে ঘরে এসে। দাঁড়িয়েছে। সমস্ত মুখ বিবর্ণ কিন্তু থমথমে। শুকনো চুলের কয়েক গোছা একদিকের গালের সামনে চলে এসেছে।
খরখরে দুচোখ ঘরের মেঝেতে বুলিয়ে নিল একবার। তারপর মালতী মাসির দিকে তাকালো। খসে পড়া শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়াতে জড়াতে আমার দিকে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়াল।
মা-কে বাবা মেরে ফেলে নি। মস্ত নিশ্চিন্ত ব্যাপার এটা আমার কাছে। কিন্তু এই মুখ দেখেও আমার কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বাবা যেন মারধর করেছে মা-কে।
ঝুঁকে আমার পায়ের ক্ষত দেখল। রক্তাক্ত চাদরটা দেখল। তারপর আচমকা ঠাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিল একটা। এত জোরে যে আমি বিছানায় উল্টে পড়েই যাচ্ছিলাম। অস্ফুট কঠিন গলায় বলল, মাটিতে নামতে গেছলি কেন?
আমি জবাব দিলাম না। মুহূর্তের মধ্যে একটা অভিমান যেন শরীর বেয়ে উঠে চোখ বেয়ে নামতে চাইল। যে মায়ের জন্য এত দুর্ভাবনা এত ত্রাস আমার, তার কিনা এই ব্যবহার! কিন্তু মায়ের দিকে চেয়ে আমি কি দেখলাম! মুখে আর গলার কাছে কয়েকটা দাগের মতো, আর জামার কাধটা ছেঁড়া–কিন্তু আসলে আমার চমক লেগেছে মায়ের চাউনি দেখে। সাত বছরের শিশু সেই রাতের চাউনি বিশ্লেষণ করতে পারে নি, কিন্তু পরে পেরেছে। আরো পরে ওই আচমকা চড় মারার আসল হেতুও আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। সেই রাতে মায়ের চোখে আমি দগদগে ঘৃণা দেখেছিলাম। আমি ওই বাড়ির ছেলে তাই ঘৃণা-মায়ের চাউনি থেকে ঠিক ওই রকম ঘৃণা আমি। বাবার দিকে একাধিক দিন ঠিকরে পড়তে দেখেছি।
ক্ষত জায়গা থেকে দুদুটো বেঁধা কাঁচ মালতী মাসি টেনে তুলল। ভয়ানক যন্ত্রণা সত্ত্বেও আমি শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করার পর পা দুটো বেশ করে ব্যাণ্ডেজ করে দেওয়া হল। মা ততক্ষণ বিছানায় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল। হাতের সরঞ্জাম রেখে এসে আর একটা ধপধপে পরিষ্কার চাদর নিয়ে মালতী মাসি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিক। সাহস করে মাকে উঠতে বলতে পারছে না।
মা আস্তে আস্তে ঘুরে তাকালো তার দিকে। চেয়েই রইল খানিক। তারপর চুপচাপ উঠে দাঁড়াল।
মালতী মাসি রক্তমাখা চাদরটা তুলে ফেলে হাতের চাদরটা চোখের পলকে যেন টানটান করে পেতে দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল। গুমরনো অভিমান সত্ত্বেও আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, মালতী মাসি একবারও মায়ের দিকে সোজাসুজি তাকালো না।
অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম হয় নি। ঘরের আলো নেভানো। মা অনেকক্ষণ বাদে তার জায়গায় এসে শুয়েছে। আমি ছটফট করছিলাম, এপাশ ওপাশ করছিলাম। তখনো যদি মা কাছে এসে দুহাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে টেনে নিত আমার অভিমান জল হয়ে যেত। মনের রাগ তখন শুধু বাবার ওপরেই বর্ষাতো।
কিন্তু মা তা করল না। স্থাণুর মতো বিছানায় পড়ে থাকল। তার নিঃশ্বাসের শব্দও কানে এলো না।
পরদিন।
সকাল থেকেও মায়ের ওই রকমই থমথমে মুখ। অভিমানের থেকে আমার বুকের তলার অজানা ভয়টাই যেন বেশি এখন। মাস্টার এসে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখল আমাকে। বার বার বিমনা হবার ফলে পড়া বলতে না পেরে বার কয়েক ধমক খেলাম তার কাছে। মাস্টার চলে যাবার পরের রুটিন চান খাওয়া তারপর স্কুল। খুব আশা করতে লাগলাম মা যদি বলে কাটা পা নিয়ে আজ আর স্কুল যেতে হবে না। কিন্তু মা তা বলল না।