অস্ফুট কঠিন সুরে মা ধমকে উঠল, তুই ঘুমুবি এখন?
সরে এলাম। মাকে কষ্ট দেয় আর গালাগালি করে বলে বাবার ওপরে অফুরন্ত রাগ ঘৃণা বিদ্বেষ। মন্ত্রগুণে শক্তি অর্জন করে মনে মনে বাবাকে যে কতদিন কতরকমের শাস্তি দিয়েছি, ঠিক নেই। কিন্তু কে জানে কেন, এই মুহূর্তে মায়ের ওপরেও আমার অভিমান কম নয়।
তারপর সেই একটা রাত। যে রাতে সাত বছরের একটা শিশু বিছানায় শুয়ে ভয়ে কাঁপছিল ঠক ঠক করে। তার ছোট বুকটা যেন ভেঙে দুমড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল আর তার ত্তার ওপর গভীর একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল।
রাত কত হবে তখন জানি না। মালতী মাসি কখন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে গেছে টের পাই নি। আমি মায়ের কাছেই শুই বটে কিন্তু ঘুমুবার সময় মা-কে আরো কম পাই আজকাল। এক-একদিন বেশি রাত করে বাড়ি ফেরে, নয়তো লোকজন বাড়িতে আসে। এদিকে, ঠিক নটা বাজলেই মালতী মাসি আমাকে চেপেচুপে ঘুম পাড়াবেই।
ঘুমুবার আগে আজ গায়ে কাঁটা দেওয়া একটা দৈত্যের গল্প ফেঁদেছিল মালতী মাসি। এক রাজার মেয়েকে সাঁ সাঁ করে বাতাস সাঁতরে নিজের পুরীতে নিয়ে এসেছিল।
হঠাৎ একটা বিকট গর্জন কানে আসতে ভয়ানক চমকে উঠলাম আমি। নিঃসংশয় দৈত্যটা এসেছে রাজার মেয়েকে ধরে নিয়ে যেতে। কিন্তু অবাক লাগছে, আমি তো বিছানায় শুয়ে, ঘরে আলো জ্বলছে!
কি বললে? কি বললে তুমি?
আবার সেই গর্জন। ঘুমের শেষ বেগটুকুও কেটে গেল। মশারির ভিতর থেকে দুচোখ টান করে আমি সভয়ে দেখলাম দৈত্য নয়, বাবা, তার হাতে বোতল একটা, রাগে বীভৎস দেখাচ্ছে বাবার সমস্ত মুখ। আর উল্টো দিকের কোণের আলমারিটার কাছে মা দাঁড়িয়ে, তারও দুচোখ যেন ধক ধক করে জ্বলছে।
বাবার গর্জনের জবাবে খুব চাপা অথচ অদ্ভুত কঠিন গলায় মা বলল, চেঁচিও না, ছেলে ঘুমুচ্ছে। তুমি শয়তান, তুমি পিশাচ!
সঙ্গে সঙ্গে হাতের বোতলটা বাবা প্রচণ্ড জোরে মায়ের পায়ের দিকে ছুঁড়ে মারল। বোতল ভাঙার সেই ঝনঝন শব্দে সমস্ত ঘরটাই বুঝি কেঁপে উঠল। তার কটা টুকরো মায়ের গায়ে পায়ে গিয়ে লাগল কিনা জানি না।
গল্পে শোনা সেই দৈত্যের থেকেও ভয়ঙ্কর মুখ যেন বাবার। গলা দিয়ে অস্ফুট আগুন ঝরাতে ঝরাতে মায়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি শয়তান… পিশাচ আর তুমি মস্ত সতী, কেমন?
মনে হল, বাঘের মতো দুটো থাবা মায়ের দুই কাঁধে বসে গেল। তারপরই দু কাধ ধরে বিষম ঝাঁকুনি গোটা দুই তিন। মশারির ভিতর থেকে আমার মনে হল, ওরকম ঝাঁকুনি দিয়েই বাবা বুঝি মাকে মেরে ফেলবে। সম্ভব হলে আমি আর্তনাদ করে উঠতাম। কিন্তু আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরুলো না।
ঝাঁকুনি খাবার পরেও মায়ের দুচোখ জ্বলছে তেমনি! সেই জ্বলন্ত চোখ মশারি কুঁড়ে একবার আমার দিকে ফিরল। সেই মুহূর্তে এক হ্যাঁচকা টানে মা দু-তিন হাত সামনে সরে এলো, হাতটা বাবার শক্ত হাতের মুঠোয় ধরা না থাকলে মা ভাঙা কাঁচের ওপরেই মুখ থুবড়ে পড়ত। টাল সামলাবার আগেই খপ করে মায়ের কোমরটা অন্য হাতে জড়িয়ে ধরে চোখের পলকে বাবা আসুরিক বলে দরজার বাইরে টেনে নিয়ে গেল, মা এতটুকু বাধা দেবারও ফুরসত পেল না। দুজোড়া জুতোর চাপে ঘরে ছড়ানো কাঁচের টুকরো মচমচ শব্দে গুঁড়িয়ে গেল।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। বুকের ওপর যেন ঠক ঠক করে হাতুড়ি পিটছে। কেউ। ঘেমে গেছি। ভয়ে ত্রাসে গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি কি করব এখন? বাবা কি মাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে গেল? মেরে ফেলছে? মায়ের আর্তনাদ কানে আসে কিনা শোনার জন্য দু কান উৎকর্ণ আমার। মাঝের দরজাটা বরাবরকার মতই বন্ধ। বারান্দা দিয়ে যাবার দরজাটা খোলা। ছুটে গিয়ে মাকে উদ্ধার করে আনতে চেষ্টা করব? মারলে বাবা না হয় দুজনকেই মারবে!
মশারি টেনে সরিয়ে মাটিতে নামলাম। কি করব আমি? একটা টু শব্দও কানে আসছে না কেন? মা-কে তাহলে শেষ করেই দিল? চিৎকার করে মালতী মাসিকে ডাকব?
উঃ! বারান্দার দরজার দিকে এগিয়েছিলাম, বেশ বড় একটা কাঁচের আধখানাই পায়ে বিধে গেল বোধহয়। কোনরকমে বিছানায় এসে বসলাম আবার। পায়ের তলা রক্ত। কি করব ভেবে না পেয়ে আমি হতভম্বের মতো বসে রইলাম।
খানিক বাদেই আমার পায়ের যন্ত্রণা মনেও থাকল না। পা বেয়ে রক্ত বিছানার ধপধপে চাদরটায় লাগছে তাও খেয়াল নেই। এক-একবার মায়ের বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছি আর এক-একবার বারান্দার খোলা দরজার দিকে। সমস্ত বাড়িটা যেন এক নিঝুম পুরী হয়ে গেছে। দৈত্যের মতই মাকে বাবা ধরে নিয়ে গেছে, দৈত্য রাজকন্যাকে প্রাণে মারে নি, কিন্তু বাবা… বাবা কি করবে? বাবাকে এই মুহূর্তে দৈত্যের থেকে ভয়ানক মনে হয়েছিল আমার।
কতক্ষণ ওই রকম ত্রাসে বোবার মতো বসেছিলাম জানি না। পনের মিনিটও হতে পারে, আধঘণ্টাও হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এক যুগ যেন। হঠাৎ সামনের আয়নার দিকে চোখ পড়তে মনে হল পিছনের জানলার ওধারে আবছা অন্ধকারে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি ঘুরে তাকালাম। মালতী মাসি। গলা দিয়ে একটা অস্ফুট স্বর ডুকরে বেরুলো যেন।মাসি শীগগির এসো!
মালতী মাসি বারান্দায় দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মেঝেময় কাঁচ ছড়ানো। অবস্থাটা দেখল চেয়ে চেয়ে! বোতল ভাঙার শব্দ আগেই শুনেছিল নিশ্চয়। ইশারায় আসছে জানিয়ে চলে গেল। এক মিনিটের মধ্যেই রাবারের চপ্পল পায়ে গলিয়ে ফিরে এলো।