- বইয়ের নামঃ ত্রিবর্ণা
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
একাকী জোনাকী
এই পরিণাম আমার জানা ছিল। সেটা কবে আসবে, কখন আসবে, কোন পথ ধরে আসবে বা শেষের আসর ঠিক এই রকমই জমে উঠবে কিনা আমার বিক্ষিপ্ত চিন্তার মধ্যে সেটা তেমন বড় হয়ে ওঠে নি। জীবনের শুরুতে কোনো ভ্রষ্টলগ্নে আমি কক্ষচ্যুত হয়েছিলাম। তখন থেকে নিজের গোচরে হোক বা অগোচরে হোক, একটা লক্ষ্যবর্তিকা আমার মনের তলায় উঁকি-ঝুঁকি দিত। মনে হত, ওই বাতিটা হাতে নিতে পারলে দস্যুর মতোই আবার সেই হারানো কক্ষের একান্ত নিভৃতে নিজের জায়গাটি অধিকার করে নেব।
ওই বাতি হাতে পাওয়াটাই লক্ষ্য, সেটাই পরিণাম। এই লক্ষ্য পরিণামকে বেষ্টন করে একটা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে কেবলই পাক খেয়ে চলেছিলাম। তাই ওই আলোর দিকে আমার হাত বাড়ানোটা এত বিসদৃশ, এমন অস্বাভাবিক। অন্ধ আবেগে সেটা ভয়াল নিষ্ঠুর কুটিল। আমার সত্তা দ্বিখণ্ডিত, সেই আক্রোশে নিজের মধ্যে আমি এক আত্মধ্বংসী ঘাতক পুষেছি, এক হিংস্র পশুকে লালন করেছি। ওই আলো দিয়ে আমার খণ্ডিত সত্তা কোনো আলো জ্বালতে চায় নি, কারো বুকের তলার অন্ধকার দূর করতে চায় নি। মশাল জ্বালতে চেয়েছে, আগুন জ্বালাতে চেয়েছে।
সেই মশালের আগুনে হিংস্র ক্ষমাশূন্য উল্লাসে নিজের তাণ্ডব নৃত্য কত দেখেছি, ঠিক নেই। শব্দশূন্য চিৎকারে প্রতিশোধের একটা জ্বলন্ত গোলা এক রমণীর বক্ষ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়েছি–মা ইন্দুমতী, তুমিও দেখো, তোমার ছেলে কেমন জ্বলছে আর পুড়ছে, দেখো! দেখো দেখো দেখো!
আজ যখন ওই আলোর কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি, হাত বাড়ালেই ধরা যায় এত কাছে–তোমরা শিউরে উঠছ, ওই পরিণামের গহ্বর থেকে আমাকে টেনে ফেরাতে চাইছ। তোমাদের বেদনার্ত মুখ দেখে আমি অট্টহাসি হেসে যাব, ভেবেছিলাম। কিন্তু তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছি এ কোনো মশাল নয়, ক্ষতবিক্ষত জীবনের এ কোনো রক্তের আখরে লেখা মাশুলও নয়। এই পরিণামের মুখে পা ফেলামাত্র সর্বগ্রাসী পঙ্কিলতার সেই ঘূর্ণাবর্ত ছায়ার মতো মিলিয়ে গেছে। ভয়াল দুঃস্বপ্ন ঘুমের ঘোরে যেমন অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তোলে, কিন্তু চোখ মেলে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়, তেমনি। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসে বুক ভরে ওঠে তখন। আমারও তাই। হয়েছে, তাই হচ্ছে। এই অস্তিত্ব যেন এক স্বস্তির সমুদ্রের ওপর হালকা ভেলার মত ভাসছি। তার প্লাবনে পৃথিবী বিহ্বল বুঝি।
পরিণামের এই আলোর রঙে আমার চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়ার রঙ বদলের উৎসব শুরু হয়েছে। আমার এই জড় দেহের শিরায় শিরায় সেই অলক্ষ্য দক্ষশিল্পী তীব্র বেদনার মীড় টেনে চলেছে। তাই দেখে বারবার তোমরা শিউরে উঠছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, এক আসন্ন প্রত্যাশার নিবিড়তায় আমার এই নিথর দেহের সমস্ত শ্বি উপশিরার তলায় তলায় এক অদ্ভুত স্পন্দন চলছে। খণ্ডকালের এই ছোট পিঞ্জরটার মধ্যে আর আমি কুলিয়ে উঠছি না দেখে তোমাদের এমনি আতঙ্ক কেন? এত আকুলতা কেন?
নিজের আনন্দে বিভোর, তাই তোমাদের করুণ মুখগুলো আমি ঝাপসা দেখছি। মা ইন্দুমতী, তোমার মুখখানা এমন পাথর কেন? এত সব সেরা অভিনয় করার। পর একটা সাদামাটা অঙ্কে এসে এই কাণ্ড তোমার! তুমি কি বুঝতে পারছ না,। মরীচিকাতে প্রেতের নাচ শেষ করে তোমার সুমন অনেক অনেক ব্যবধান পেরিয়ে যেখানে ছিল ঠিক সেইখানেই ফিরে এসেছে? তুমি শিল্পী, আর ওই অলক্ষ্য শিল্পীর কাজ দেখে তুমি মুগ্ধ হতে পারছ না? তাহলে তোমার পাশে তাকাও, বাবার মুখখানা দেখো, আর তার পাশে নতুন মায়ের মুখখানাও। এবারে পারছ মুগ্ধ হতে? ওই শিল্পী রসিক কতো, বুঝতে পারছ?
যশোদা, তুমিও এসে গেছ! কী কাণ্ড, ঘরে তোমার গোপাল কাঁদছে না? আর শোভা মিতা তোমরাই বা খবর পেলে কি করে? রেডিও আর খবরের কাগজগুলো সব দেশ থেকে তুলে দেওয়া যায় না!
দোহাই তোমাদের, তোমরা আর যাই করো, শোক করো না! আমার এই স্তব্ধ অনাবিল মুহূর্তগুলিকে শোকের শেকল পরিও না! এই কপালে শোকের তিলক কেটে দিয়ে তোমাদের অতি সাধারণ সুমনকে অসাধারণ করে তুলতে চেও না! মিনতি রাখো, শোক করো না–শোক করো না!
***
চোখ বুজলে এমন কি চোখ চেয়েও অনেক সময় সাত বছরের কালো-কোলো একটা মিষ্টি-মুখ ছেলেকে আমি দেখতে পাই। ওই ছেলেও চেয়ে চেয়ে দেখে আমাকে, কারণ আমি তাকে অহরহই ডাকি। দুষ্টু-দুষ্টু ডাগর চোখ, এক-মাথা ঝাকড়া চুল, ফোলা-ফোলা দুই গালে যেন টোকা দিলেই অভিমান ঝরবে। আমি ওকে বলি, হা রে, তুই কি কোন দিন বড় হবি নে, কাছে আসবি নে?
ওই ছেলেটা আমি নিজেই। ওর নাম সুমন।
ও আমার ডাক শোনে, কথা শোনে না।
আমি ওকে বলি, দেখ সুমন, আসলে তো তুই আর আমি এক, তুই ছোট সুমন আমি বড় সুমন। কিন্তু তুই আলাদা হয়ে গিয়ে আমার ভিতরটা আধখানা করে রেখেছিস। তুই কাদিস, ককিয়ে উঠিস আর সেই যন্ত্রণায় আমিও অস্থির হয়ে উঠি। তুই নিজে অমনি ছোট হয়ে থেকে আমাকেও পঙ্গু করে রাখিস কেন? তার থেকে তুই আমার কাছে চলে আয়, দুজনে এক হয়ে যাই–তোরও মুক্তি, আমারও মুক্তি।
ও গাল ফুলিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে, আসলে নিজের মধ্যে নিয়ে তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাও। তুমি তো একটা খুনে–দিন-রাত কেবল মাকে মেরে ফেলার বুদ্ধি আঁটছ মাথায়, যেই তাকে মারার জন্য হাত তোলো আমি আর্তনাদ করে উঠি, আর তখন তুমি হাত গুটিয়ে নাও। সেই জন্যেই নিজের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাকে মারার মতলব তোমার।