কিন্তু এ আনন্দ খুব বেশিদিন থাকল না। গোড়ায় গোড়ায় হাতে যা পেত, ভাবত অনেক টাকা। কিন্তু কয়েকটা মাস না যেতে মাইনের অঙ্কটা কেমন জ্যোতিশূন্য ঠেকতে লাগল চোখে। তার প্রধান কারণ, সে হিসেব করে খরচ করতে জানে না। চোখে বা মনে কিছু ধরলে সেটার অধিকার না মেলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। দার্জিলিংয়ের মতো জায়গায় শীতের ভব্যসব্য বেশবাসের ব্যবস্থাতেই অনেক খরচ। এ ব্যাপারে স্কুল। মিসট্রেস বলে সে মান খাটো করতে রাজি নয়। তার ওপর খাওয়া-দাওয়া আর প্রসাধনসামগ্রীর খরচ। মাস কাবার হবার আগে প্রতিবারই দস্তুরমতো ফাঁপরে পড়ে যায় রাখি গাঙ্গুলি।
এই কারণেই স্কুলের চাকরির ওপর বিরূপ সে। মাইনেটা আরো শদেড়েক টাকা বেশি হলেও মনের আনন্দে কাটাতে পারত। টিচাররা আর মেয়েরাও সৌখিনভাবে থাকে। আড়ালে তাকে নিয়ে কথাও হয়, এটুকু বাড়তি মর্যদার মতো। এর থেকে নেমে আসতে মন সরে না। সেই ছেলেবেলা থেকেই দৃষ্টি উঁচুর দিকে, তার কী দোষ! দোষ ভাবে না, কিন্তু মাসের শেষে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
.
এই শৈলশিখরেই সুবীরকান্তর সঙ্গে আলাপ এবং পরিণয় বিধিলিপি।
সুবীরকান্ত চক্রবর্তী:এখানকার কলেজের নতুন মাস্টার। নতুন বলতে দার্জিলিং এ নতুন। হুগলি না কোথাকার কোন কলেজ থেকে বদলি হয়ে এসেছে।
এ-সব পরের বৃত্তান্ত।
বিকেলে ম্যাল বা বাজারের দিকে সেজেগুজে বেড়াতে বেরিয়ে রাখি গাঙ্গুলির দিনকয়েক মনে হল দুর থেকে এক অল্পবয়সী ভদ্রলোক তাকে নীরবে লক্ষ্য করে। তা লক্ষ্য অমন অনেক সময় অনেকেই করে। এখানে মৌসুমের সময় বেড়াতে যারা আসে, পাহাড় দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের যেন মেয়ে দেখে বেড়ানোর বাই চাপে। এ তো তবু তার দিকে চেয়ে থাকে, রাখি এও দেখেছে, নীচের থেকে বেড়াতে এসে এখানে খেটে আর মেহনতী করে খায় যে মেয়েগুলো, হ্যাংলার মতো লোকগুলো ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।…কিন্তু এ লোকটার তাকানোটা সে-রকম মনে হয়নি রাখির। বেশ পরিষ্কার চাউনি, আর বেশ একটু উৎসুক ভাব।
একদিন লেবংয়ের পথে দেখা হল। রাখি নামছিল আর লোকটা উঠছিল। ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছল। রাখিও থামলে এগিয়ে এসে কথাই বলত হয়ত, কিন্তু রাখি দাঁড়ায়নি বা থামেনি। স্কুল-টিচারের এ-ধরণের গায়ে-পড়া আলাপ বরদাস্ত করা ঠিক নয়, এটুকু জ্ঞান তার আছে।
আর একদিন জলাপাহাড়ে দেখা। এই দিন আর আলাপ ঠেকানো গেল না। মাঝে মাঝে এসে বসে এখানে। সহকর্মিণীরাও সঙ্গে থাকে প্রায়ই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি, রাখি একাই বসে গুনগুন করে গান গাইছিল। এক সময়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে অদূরে লোকটা দাঁড়িয়ে। উৎসুক দৃষ্টি, ঠোঁটের ডগায় সামান্য। হাসির আভাস। চোখাচোখি হতে দুহাত জুড়ে নমস্কার জানিয়ে লোকটা এগিয়ে এলো।
–কিছু মনে করবেন না, আপনার নাম রাখি গাঙ্গুলি?
সরাসরি একেবারে নামের ওপর চড়াও না হলে এই আলাপের ইচ্ছেটা রাখি বাতিলই করে দিত। কারণ এক্ষুনি সুলতাদি বা মুখরা রমলাদি ওদের কেউ এসে গেলে জেরার চোটে রাখিকে অস্থির করে মারবে। কিন্তু অচেনা লোকের মুখে নিজের নাম শুনে বিরক্তির বদলে অবাক হল। মাথা নাড়তে আবার প্রশ্ন হল, আপনি। জলপাইগুড়ির মেয়ে আর ওমুকের ভাইঝি তো?
ছোট কাকার নামই করল। কিন্তু এবারের প্রশ্নটা কেন যেন খুব মার্জিত ঠেকল রাখির কানে।
এবারেও মাথা নেড়ে মৃদু প্রশ্ন করল, আপনি?
লোকটা জবাব দেবার আগে আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো। পাশে বসেই পড়ে কিনা সেই ভয় রাখির। হাসিমুখে জবাব দিল, আমি জলপাইগুড়িতে আমার কাকার বাড়িতে অনেকবার কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আমার কাকা আপনার কাকার খুব বন্ধু। তখন আপনাকে তিস্তার ধারে অনেকবার দেখেছি।
কাকার যে নাম করল, সেটা বিলক্ষণ চেনাই বটে। রাখির ছোট কাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু শুধু নয়, সে বাড়িতে রাখি বা রাখির মায়ের যাতায়াতও আছে। ওদের বাড়ির মেয়েরাও তাদের বাড়িতে আসে। কিন্তু কাকার বন্ধুর ভাইপোর সঙ্গে আর আলাপ বাড়ানোর ইচ্ছে খুব নেই রাখির। সুলতাদি-রমলাদিরা আসার আগে সরে গেলেই ভালো হয়। তাই নিস্পৃহ একটা উক্তি বেরুলো গলা দিয়েও…।
কিন্তু লোকটার কেটে পড়ার ইচ্ছে নেই বোঝা গেল। হাসিমুখে বলল, আমার নাম সুবীরকান্ত চক্রবর্তী-এবার এখানে আসার আগেও জলপাইগুড়িতে কাকার বাড়ি হয়ে এসেছি। কাকা আপনার কথা বলছিলেন, আপনি এখানকার স্কুলে কাজ করছেন। …দেখা করে আলাপ করতে বলেছিলেন, আপনার কাকাও বলেছিলেন। হাসল। কিন্তু কদিন আপনাকে দেখেও ঠিক ভরসা পেয়ে উঠিনি। আর আপনার সঙ্গে প্রায়ই অন্য মেয়েরাও থাকেন…তাই একদিন আপনাদের বোর্ডিংয়েই যাব ভাবছিলাম।
আলাপে এগোতে ভরসা পেয়ে ওঠেনি পর্যন্তই শুনতে খারাপ লাগেনি। নিতান্ত সৌজন্যের খাতিরেই রাখি গাঙ্গুলি জিজ্ঞাসা করল, এখানে বেড়াতে এসেছেন?
এই সামান্য প্রশ্নটাই যেন একটা পাথর ছেড়ে পরের পাথরটায় বসে পড়ার পাসপোর্ট। কিন্তু জবাব যা পেল তা শোনার জন্যে খুব প্রস্তুত ছিল না রাখি গাঙ্গুলি। বলল, বেড়াতে এলে তো কবেই পালিয়ে বাঁচতাম। এসেছি এখানকার কলেজে মাস্টারি। করতে। কী কুক্ষণেই যে বদলি হতে রাজি হলাম!
কলেজের মাস্টার শুনে রাখি এবার এবং এই প্রথম কাছে থেকে ভালো করে দেখল মানুষটাকে। ছোট করে ছাঁটা চুল, চাকচিক্যশূন্য সাদামাটা মুখ–কেবল চাউনি ভারি পরিষ্কার আর উজ্জ্বল। চোখ দুটো লক্ষ্য না করলে মানুষটাকে নিরীহ বোকা। গোছের মনে হবে।