সমীর অবাক হয়ে বলে, আলো ফিউজ মানে?
মালতি কৌতুকে চোখ নাচিয়ে বলে, কী গো বলে দেব না কি মানেটা?
সুধাকর চশমার মধ্যে থেকে একবার স্ত্রীর মুখটা দেখে নেয়। না, সেখানে হিংস্রতার কোন আভাস নেই। শুধুই কৌতুকে ফেটে পড়া ভাব। তবু সুধাকর–দারুণ অস্বস্তি বোধ করে। মালতি আজ ভেবেছে কী!
তবু সুধাকর তো ওই কৌতুকাভিনয়ের জুটির একজন। তাই সুধাকর বৈরাগী-বৈরাগী মুখ করে বলে, বলো। গল্প তো তোমার মুখে মুখে। দে ভাই সমীর, তোর দিদির গল্প বানাবার এই অসামান্য প্রতিভাটি এই হতভাগ্যের সঙ্গে চালাকি করে করেই মাঠে মারা গেল। লিখলে একটা নামকরা লেখিকা হতে পারত।
তা হয়তো পারতাম
মালতি ওদের দিকে সন্দেশ আর সিঙাড়ার প্লেট সরিয়ে দিয়ে, নিজের বড় মাপের পেয়ালাটা নিয়ে গুছিয়ে বসে বলে, হলে প্লটের অভাব হত না। তা শোন একটা গল্পই বলি, সমীর তোর তো কী একটা কাগজের সঙ্গে জানাশোনা আছে, বলিস তো লিখি, ছাপিয়ে দিস। গল্পটা হচ্ছে এই–একটা বিয়ে-বাড়ি! বেশ সমারোহের বিয়ে, লোকে লোকারণ্য। যত রঙের ঘটা, তত রূপের ছটা, যত হি হি খিলখিল, তত ঝলমলানি।.আর রোশনাইয়ের তো কথাই নেই। আলোর ঝালর দিয়ে মুড়েছে বাড়িটা। ওমা। সব থেকে জমজমাটি সময়ে বর আসে আসে, হঠাৎ দুম করে সারা বাড়ি ঘুটঘুঁটে। তখন বাবা এত লোডশেডিংয়ের চাষ ছিল না, সবাই হৈ-চৈ করে উঠল, ফিউজ ফিউজ। বিয়ে বাড়ি-টাড়িতে হয় এখন।…কিন্তু অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-মহলে দারুণ আর্তনাদ, কে? কে? কে?
এদিকে কর্তারা ওদিকে কর্ণপাত না করে ডাক-হাঁক লাগিয়েছেন, ঘর সামলাও, ভাড়ার সামলাও, মেয়েরা গহনা সামলাও, মিষ্টির ঘরের চাবি কার কাছে? কনের কাছে কে আছে? …ওদিকে কে যেন পুলিস পুলিস রব তুলে চেঁচাতে লেগে গেছে, তারই মধ্যে কোনও একটা ছেলে একটু ফিউজওয়ার জোগাড় করে মেনসুইচে হাত দিয়ে অবাক! সুইচটাকে অফ করে দিয়েছে। ওই রমরমা সময়ে কি না হঠাৎ মেনসুইচ অফ! গল্পের বাকি অংশটা অনুমানে বোঝ।
সমীরও হতবাক।
এর আবার বাকি অংশই বা কী? অনুমানই বা কী? কেউ মজা দেখতে অফ করে দিয়েছিল!
মালতি গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চায়ের পেয়ালা শেষ করে ফেলেছে। এখন সেটা ঠুকে নামিয়ে রেখে বলে, নাঃ এই অবোধ বালকটাকে নিয়ে কিছু করার নেই। বাকি অংশটা বুঝবে এই বৌটা? কী রে বুঝবি না?
সুরঙ্গমা মুখ নীচু করে হাসে।
মালতি গম্ভীর গলায় বলে, বলি অবোধ বালক, সেই তরুণীকুলের আর্তনাদ বুঝি তোর কানে প্রবেশ করল না? করবে কেন? পুরুষ যে! যাক বৌটা বুঝেছে। কিন্তু কী বলব, একটাও মেয়ে বৌয়ের মুখ থেকে আদায় করা গেল না, তারা সবাই অমন কে? কে? করে চেঁচিয়ে উঠেছিল কেন?…এরকম প্লট আমার স্টকে অনেক আছে।
সমীররা উঠে পড়েছিল।
তবে দাঁড়িয়ে উঠেই তো আসল গল্প শুরু হয়।
সমীর বলল, যাই বল মালতিদি, তোমার এবার একটু গম্ভীর হওয়া উচিত। চুলে টুলে পাক ধরে এল–
মালতি গাল দুটো ফুলিয়ে বলে, ঠিক আছে। এই হলাম গম্ভীর। তা ঘটনাটা কোথায় ঘটছে?
সমীর হেসে ফেলে বলে, কোথায়? কোথায় নয়? কলকাতার আশে-পাশে যত পিকনিক স্পট আছে। সব জায়গাতেই একবার করে মনপবনের নায়ে চড়ে যাওয়া হয়েছে। অবশেষে বোটানিক্সে–
বোটানিক্সে!
মালতি হাততালি দিয়ে উঠে বলে, ওঃ কী মৌলিক চিন্তা! কী আশ্চর্য আবিষ্কার। সমীর কার মাথা থেকে এমন অনাস্বাদিত নতুন জায়গাটার নাম ঝরে পড়ল?
সমীর দুষ্টু হাসি হেসে বলে, এই অসাধারণ আবিষ্কারের নায়িকা তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে।…বলে কিনা কখনও বোটানিক্সে যায় নি।
আশ্চর্যের কিছু নেই। মালতি বলে, আমি তো কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যাই নি।
তাহলে?
নতুন বৌ হেসে বলে, ওই নিয়ে বাড়িতে যা হাসাহাসি! তবু আমার দলে একজন আছেন।
মালতি উদাস গলায় বলে, সাধে আছি রে! ও সব জায়গায় গেলে কি আর লোকটাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম? কার আঁচলের সুতো ধরে কোথায় হাওয়া হয়ে যেত।
সুরঙ্গমার নতুন করে আবার ভাল লাগে।…এঁদের জীবন-দর্শনটি বেশ! হেসে-খেলে কাটিয়ে দেওয়া …এই তো তার এক খুড়ি আছেন, ছেলে-মেয়ে হয় নি, তিনি রাতদিন পেঁচামুখ করে ঘুরে বেড়ান, যেখান থেকে পারেন, আর যত পারেন মাদুলী এনে এনে পরেন, আর যত পারেন ডাক্তার দেখান। দেখলে রাগ ধরে।.ছেলে-মেয়ে কী এমন নিধি রে বাবা! কী সুন্দর এঁদের এই জীবন! হাসি-আহ্লাদ মজা! এই নিয়েই আছেন!
তাহলে সেই আদি ও অকৃত্রিম বোটানি?
হ্যাঁ!
ওকে নিয়ে যেতেই হবে?
না নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছেই না।
ঠিক আছে, তবে জেনে রেখো–তোমরা যা করছে, নিজ দায়িত্বে করছো। ও যদি কোনও কেলেঙ্কারি করে না বসে তো কী বলেছি।
নতুন বৌ হি হি করে হেসে ফেলে চটি পায়ে দেয়।
সেই দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে ভাবে সুধাকর, মেয়েগুলো কি চতুর!…আর হাসলে ওদের যা দেখায় না!….
ওরা চলে যেতেই সুধাকর আর সুধাকরের মূর্তিতে থাকে না, বিষধরের মূর্তিতে ফণা তুলে বলে ওঠে, খুব গৌরব বাড়ল, কেমন? স্বামীর মুখে দোহাত্তা চুনকালি মাখিয়ে নিজের মুখটা খুব উজ্জ্বল হল?
মালতির সেই খুশীতে আর কৌতুকে ফেটে পড়া লালচে মুখটা একদম ঝুলে পড়ে কালচে মেরে গেছে।
গালের টোলটা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে সারা মুখটাই টোল খাওয়া।