সমীর তো অবাক।
পিকনিকের কথায় তোমার বুক ধড়ফড় করে উঠল?
মালতি মুখ-চোখ করুণ করে হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে, করবে না? ওই বুড়ো মস্তানকে একঝাক সুন্দরী সুন্দরী তরুণীর মাঝখানে ছেড়ে দিলাম, ভাবলে বুক স্থির থাকতে পারে?
মালতির কথাবার্তা চিরদিনই এই রকম, তবু নতুন বৌয়ের সামনে অস্বস্তি পায় সমীর, তাড়াতাড়ি বলে, মালতিদি, মাত্রা ছাড়াচ্ছ।
সুধাকর ওখান থেকেই চেঁচায়, দেখছিস তো ভাই? বুঝছিস, তোদের দিদির ছ্যাবলামির বহর? কোথায় বয়েস হয়ে কমবে, তা নয়–
মালতি তেমনি হতাশ ভঙ্গিতে বলে, আমিও তো তাই ভাবি, কোথায় বয়েস হয়ে কমবে, তা নয়, বুড়ো হয়ে যেন আরও
সমীর আর তার বৌ দুজনে একটা কৌতুক আর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে।
যে দৃষ্টির অর্থটা হচ্ছে, বয়েস হলে কি হবে, দুজনের রঙ্গরসের লীলাটি আছে বেশ।
সমীর আর একটা ভঙ্গিতে দুহাত উল্টে বোঝায়, ছেলে-মেয়ে তো হয় নি, তাই যেমন ছিলেন তেমনি আছেন।
দৃষ্টি-বিনিময়টা অবশ্য ক্ষণিকের ব্যাপার। ধরা পড়ে না।
অন্তত ওরা ভাবে ধরা পড়ছি না।
সুধাকর তার চেয়ারটা হিড়হিড় করে টেনে ঘরের দরজার কাছ পর্যন্ত এনে বসে।
সমীর বলে, এটা কী হল জামাইবাবু?
উত্তরটা মালতি দেয়, বুঝছিস না? সীতা গণ্ডী পার হবেন না! তা এটা তো নিজের অসুবিধেই ঘটালে গো। ওখান থেকে তবু কটাক্ষপাতটা তত ধরা পড়ছিল না।..সমীর তোর বৌয়ের কড়ে আঙুলটা একটু কামড়ে দে
বলা বাহুল্য, ওরা রোল তুলে হেসে ওঠে।
সুধাকর করুণ হয়ে বলে, দেখো মালতি, সমীরের তবু তোমার এই স্ট্রং ঠাট্টা-টাট্টা গুলোর সঙ্গে কিছুটা পরিচয় আছে, কিন্তু ওর নতুন বৌয়ের পক্ষে বড্ড গুরুপাক হয়ে যাচ্ছে না?
মাই গড!
মালতি কপালে হাত দিয়ে বলে, ঠাট্টা। ঠাট্টা করছি আমি? এখনও তুমি মাছ ঢাকতে শাক তুলছ? নতুন বৌটাকে অবহিত করিয়ে দেবার জন্যেই তো আমার এত কথার অবতারণা। …তুই তো জামাইবাবুকে দরাজ নেমন্তন্ন করে বসলি। বেচারা ইনোসেন্ট মেয়েটা পিকনিকের হৈ-চৈয়ের মধ্যে নিশ্চিন্দি হয়ে ঘুরে বেড়াল, অথবা হয়তো বিজ্ঞ-সিজ্ঞ ননদাইয়ের হাতে নির্ভয়ে পানের খিলি এগিয়ে দিতে এল, তারপর ভবিতব্যে কী ঘটবে, জানে না তো।
মালতিদি, সত্যিই একটু অধিক স্ট্রং হয়ে যাচ্ছে। সমীর প্রসঙ্গ পালটাতে বলে, তুমি বরং আমাদের চা আনো, আমরা ততক্ষণ জামাইবাবুর কাছে হাত দেখাই।
হাত? দেখতে জানেন উনি?
নতুন বৌ সুরঙ্গমা নতুন বৌত্ব বিসর্জন দিয়ে ফটু করে হাতটা বাড়িয়ে ধরে, আমারটা আগে দেখুন।
মালতি খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল বোধকরি চায়ের জন্যেই, আবার ধপ্ করে বসে পড়ে বলে, নাঃ, এই সমীরটা যে এত হাঁদা তা জানতাম না। তুই সত্যি বিশ্বাস করিস ও হাত দেখতে জানে?
জানেন না? বাঃ! কত দেখেছেন।
মিলেছে?
তা অনেক সময় মিলেছে তো–
মালতি সমীরের মাথাটা নেড়ে দিয়ে বলে, ছাই মিলেছে। সব ফোর টোয়েনটির ব্যাপার। আসলে হাত দেখতে জানি বললে হাতের মধ্যে অনেক কোমল করপল্লব এসে ধরা দেবেই, নিরীক্ষণ করে দেখতে বেশ কিছুক্ষণ নিপীড়ন চালানো যায়।
নাঃ মালতিদি, তুমি ওঠালে–
সমীর হাসতে থাকে, সত্যিই তোমার মুখ দিন দিন বেশি আলগা হয়ে যাচ্ছে মালতি এমন একটা গভীর দুঃখের ভঙ্গিতে নিশ্বাস ফেলে বলে, অনেক দুঃখেই যাচ্ছে রে যে আবার একদফা হাসির রোল না উঠে যায় না।
সুধাকর উদাস গম্ভীর ভাবে বলে, শালাবাবু, তোমার বৌয়ের মানসিক স্বাস্থ্যটি ভালই বলতে হবে, এত গুরুপাক বস্তুগুলোও পাক করে ফেলছে দেখছি।…কিন্তু ভাই, তোমাদের ওই লিস্ট থেকে এই নরপিশাচ পাষণ্ডের নামটা বাদ দাও, আমি বরং সেদিন একা বাড়ি বসে নিশ্চিন্ত মনে ভাগবত পাঠ করব।…ঈদের ছুটি আছে তো পরশু?
ভাগবত পাঠ!
নতুন বৌ রুমাল মুখে দিয়ে হাসি চাপতে কেশে ওঠে।
তারপর কষ্টে কথা বলে, উঃ মালতিদি, আপনি না কী যে সাংঘাতিক! সারাক্ষণ আপনি ওঁকে এইভাবে জ্বালান?
সুধাকর তো ততক্ষণে নতুন বৌয়ের হাতটা দেখবার জন্যে বাগিয়ে ধরেছে। নিরীক্ষণ করতে করতে বলে, দেখ ভাই দেখ। তবে শিখিস না।
মালতির চিরকাল দেখা আছে এই লোকটাকে চটিয়ে দিয়ে কিছু লাভ করতে পারে না। ও স্রেফ পিটে কুলো আর কানে তুলোর নীতিতে আশ্রয়ী।
মালতি তাই হাল-ছাড়া গলায় বলে, আহা ছুটির দিন একা বাড়িতে বসে ভাগবত পাঠ করবে! এমন দিনও হবে? হে মা কালী, তোমায় হরিরলুঠ দেব, লোকটার যেন সত্যিই সে সুমতি হয়।
সুরঙ্গমার ভারি ভাল লেগে যায় সমীরের এই দিদি-জামাইবাবুকে। জীবনকে এঁরা সিরিয়াস করে তোলেন নি। দুজনেই সমান হাসি-খুশী। দুই জুটিতে মিলে দিব্যি একখানি কৌতুকানিভয় করে চলেছেন।…এঁরা পিকনিকে গেলে খুব জমাবেন।
মুখে বলে, কই বলুন? কী দেখছেন?
সুধাকর খুব গম্ভীর মুখে বলে, দেখছি কিছুদিন আগে একটা নিশ্চিত বিয়ের যোগ ছিল সম্প্রতি সেটা কেটে গেছে। আর তো কই–সে যোগ দেখছি না।
সমীর গলা ছেড়ে হেসে ওঠে।
বৌ লুটোপুটি খায়।
ইত্যবসরে, বোধহয় মালতির ইশারার নির্দেশে চাকর চায়ের ট্রে এনে নামায়, মালতি পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে বলে, তাহলে সমীর, আমরা যাচ্ছি তোদের দলে
নিশ্চয়। অবশ্য অবশ্য!
মালতি ওদের দিকে চা এগিয়ে দিলে, ভরসার মধ্যে খোলা মাঠ-ঘাট, আর দিনের বেলা। আলো ফিউজের ভয়টা নেই।