- বইয়ের নামঃ যুদ্ধ
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
যুদ্ধ
মালতিদি তার টোল খাওয়া গালে আরও টোল ফেলে চাপা হাসি হেসে বলে, নতুন বৌয়ের অনারে পিকনিক করছিস? বেশ বেশ! শুনে প্রাণে বড় আনন্দ পেলাম রে! কী কালেই আমরা বিয়ে করেছিলাম! তা যাক, আমাদেরও যেতে বলছিস? মানে তোদের জামাইবাবুকেও?
মালতির মামাতো ভাই সমীর, যে নাকি এই পিকনিকের আহ্বায়ক, সে এ প্রশ্নে প্রায় রেগে উঠে প্রতি-প্রশ্ন করে, না তো কি জামাইবাবুকে বাদ দিয়ে তোমায় একা?
সমীর সবে এইমাত্র বিয়ে করেছে, অতএব তাকে এখন উদার মুক্তহস্ত, আর বিশ্বপ্রেমী হতে হয়েছে। তুতো-টুতো মিলিয়ে যে সব গাদাগাদা বোন আর বৌদির সম্পর্কে এ যাবৎ উৎসাহের কোনও চিহ্ন দেখা যায় নি সমীরের তাদের সব্বাইকে জুটিয়ে নিয়ে বিয়ের অষ্টমঙ্গলার মধ্যেই মহোৎসাহে দুদিন সিনেমা আর একদিন মুক্তাঙ্গনে থিয়েটার দেখানো হয়ে গেছে, আবার এখন এই পিকনিকের তোড়জোড়।
পিকনিক তো আরও ব্যাপক ব্যাপার।
কিন্তু সে ঝুঁকি সমীর স্বেচ্ছায় মাথায় নিয়েছে এবং কন্যাদায়ের মতই এ-বাড়ি ও-বাড়ি নেমন্তন্ন করে বেড়াচ্ছে।
আসল কথা, বিয়ে বাবদ যে ছুটিটা নেওয়া হয়েছিল, তার এখনও দিন চার-পাঁচ মাত্র হাতে আছে, এতে মধুচন্দ্র-যাপনে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, অথচ একটা কিছু না করলেও মন উঠছে না। ছুটিটা বরবাদ যাবে কেন? তার শেষ মিনিটটি পর্যন্ত নিংড়ে নিংড়ে সুখের সুধাবিন্দু আহরণ করে নিতে হবে না?
অবশ্য সে আহরণের আরও অনেক বেশি রিফাইন্ড পদ্ধতি ছিল, আছে। কিন্তু সমীরদের জন্যে ছিল না, নেই।
সমীরদের বাড়ি এমন নয় যে সেই রিফাইড় পদ্ধতিকে সমর্থন করবে। ওদের পরিবার এখনও বিগত যুগের নীতিতে বিশ্বাসী। পারিবারিক কোনও ব্যাপারে সমবেত সঙ্গীতের তান না উড়লে ওরা আহত হয়।
তাই সমীরকে পিসতুতো দিদির দরবারেও এসে আবেদন জানাতে হচ্ছে। আবেদন আর কিছু না–আমাদের আনন্দে যোগ দিয়ে আমাদের বাধিত কর।
অবশ্য মালতিদি সম্পর্কে সমীরের মনোভাব দায়সারা নয়, বরং রীতিমত উচ্চ।
আসার আগে নতুন বৌকে সে বিশদ বুঝিয়েও এনেছে, মালতিদি? ওঃ! একাই একহাজার! যা জমাতে পারে, দারুণ! তেমনি করিৎকর্মা। মালতিদি গেলে একাই পিকনিকের সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলতে পারবে। আর যা সাংঘাতিক ভাল রান্না না মালতিদির! বলে বোঝানো যায় না।
নতুন বৌ এই উচ্ছ্বাসকে কী চক্ষে দেখত কে জানে, তবে মালতিদির বয়েসটা জেনে ফেলে বোধহয় নিশ্চিন্ত আছে। সমীরের থেকে অন্তত বছর দশেকের বড় মালতিদি।
পিকনিকে গিয়ে একাই সবকিছু ম্যানেজ করতে পারে, এমন একজন বয়স্কা মহিলা সুবিধেজনক। অন্যদিকেও মহিলাটিকে সুবিধের খাতায় বসানো চলে।
আরও যে সব দাদা-বৌদি, দিদি-জামাইবাবু, শালী-শালীপতি, বা শ্যালক-শ্যালকপত্নীর সঙ্গ প্রার্থনা করা হয়েছে, সকলেরই সঙ্গে কিছু না কিছু সাঙ্গোপাঙ্গো আছে, যারা পিকনিক-পার্টির দলবৃদ্ধি করতে যাবে।
মালতিদিদেরই কোনও সৈন্যবাহিনী নেই। ওরা মাত্র দুজন।
তা ওই দুজনের মধ্যেও আবার একজনকে বাদ দেওয়ার কথা বলছে মালতিদি!
পাগল নাকি!
সেই জনটিই কি ফেলনা?
জামাইবাবুর গুণই কি কম?
জামাইবাবু দাবায় ওস্তাদ, তাসে পটু, আড্ডায় একনম্বর, তার উপর আবার হাত দেখতে জানে, ম্যাজিক দেখাতে পারে।
এসব গুণ মজলিশের পক্ষে আদর্শগুণ।
অতএব সমীরকে বলতেই হয়, পাগল নাকি?
মালতি তার স্পেশাল হাসি হেসে বলে, পাগল নাকি? তোর জামাইবাবুর সঙ্গে ঘর করতে করতে শুধু পাগল কেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে বসে আছি। সে কথা যাক, ভাবনা তোদের নিয়ে। নতুন বৌ নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করতে যাচ্ছিস, তাই বলা। তোদের জামাইবাবু পুরো পার্টিটাকেই না পাগল করে ছাড়ে।
একালের নতুন বৌরা সেকালের মুখে তালাচাবি আঁটা নতুন বৌ নয়। সমীরের নতুন বৌ সুরঙ্গমা মৃদু হেসে বলে, বড্ড বেশি গৌরবদান করা হচ্ছে না মালতিদি?
মালতি চাপা কৌতুকের হাসি হেসে বলে, বেশি? আচ্ছা ঠিক আছে, নিয়ে যাও, বুঝবে ঠ্যালা।
বাজে কথা রাখো মালতিদি, সমীর বলে ওঠে, সব সময় তুমি জামাইবাবুর নিন্দে কর কেন বল তো?
আজ রবিবার, সুধাকর বারান্দায় বসে খবরের কাগজ ওল্টাচ্ছিল। সমীরদের আসতে দেখে এ ঘরে এসে বসছিল, মালতি তাকে ভাগিয়েছে ঘর থেকে। বলেছে, কাগজ পড়ছিল পড়গে না। শহরে কটা রাহাজানি, কটা ছিনতাই, কটা নারীহরণ হচ্ছে দৈনিক, তার হিসেব রাখগে। আমরা ভাই-বোনে দুটো মনের প্রাণের কথা কইব–
সমীর হৈ চৈ করেছিল, মালতি বলেছিল, ঠিক আছে বাবা, কুটুম নয় যে অপমানের জ্বালায় চলে যাবে।
আর সুধাকর হেসে হেসে বলেছিল, চিন্তার কারণ নেই শালাবাবু, ঘরের বাইরে থেকেও মন প্রাণ কান সব তোমাদের কাছেই রইল।
এখন বলে উঠল, ওহে শ্যালক, পারবে, পারবে, বুঝতে পারবে, এরপর থেকে পারবে। এর নাম কি জান, কৃষ্ণকথার সুখ। শ্রীরাধিকা বলে গেছেন, নিন্দাচ্ছলে কৃষ্ণর কথাই তো কইছে–
মালতি একবার কটাক্ষে ওদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, থাক থাক, শাক দিয়ে আর কদিন মাছ। ঢাকবে? সমীর, তোর নতুন বৌয়ের সামনে ফাঁস করে দেব নাকি কথাটা?
সমীর বলে, যদি নতুন বৌ বলে সমীহবোধ কর, নাই বা করলে?
মালতি তেমনি কৌতুকের গলায় বলে, না বাবা, সাবধান করে দেওয়া ভাল। সত্যি বলতে–তুই যেই পিকনিকের কথা তুললি, তক্ষুনি আমার বুকটা ধড়ফড় করে উঠল।