ঘড়ি। ঘড়ির কথা! কোন্ ঘড়ি!
হরিগোপাল গৃহিণীকে কেউ যেন আচমকা জলে ফেলিয়া দিয়াছে।
হরিগোপালের স্বরে গাম্ভীর্য, কোন্ ঘড়ি মনে পড়ছে না? দয়াময় যেটা নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। আমার সেই রোলেক্সটা–
আ। ছি ছি। এতকাল পরে আমি সেই ঘড়িটার কথা জিগ্যেস করবো। কথাটা মুখ দিয়ে বার করলে কোন্ লজ্জায়। কী একখানা গাড়ি চড়ে এসেছে, দেখেছ?
তোমরা দেখগে। যাক আমিই বলছি গিয়ে ঘড়িটা কী করলি রে বঙ্কা।
ইস! বলছ কী? ওর সামনে মুখ দিয়ে বার করতে পারবে? একটা কপর্দকশূন্য ছেলে। নিঃসহায় অবস্থায় থেকে এই ক বছরে কোথায় উঠে গেছে ভাবা যাচ্ছে না, আর তুমি কিনা সেই ভাঙা ঘড়িটার কথা।
হরিগোপাল আরও গম্ভীর হল, ঘড়িটা ভাঙা ছিল না, কাঁটা আটকে রাখা হয়েছিল।
ওমা! এ আবার কী কথা! কে আটকে রেখেছিল?
উত্তরটা শোনা হইল না।
ঘড়ির কথা কী হচ্ছিল বড়মামা? বলিতে বলিতে বঙ্কিমবিহারীর উদ্দাম প্রবেশ। দেখা গেল আর যতই যা বদল হোক, চিরদিনের প্রবেশভঙ্গীটার বদল হয় নাই বন্ধুর।
তা বড়মামার আগেই বড়মামী ভাগিনেয়র প্রশ্নের উত্তরটা দিয়া দেন। সরল, উচ্ছল, এই তোর হাতের ঘড়িটার কথা বলছিলাম তোর মামাকে। কী অপূর্ব দেখতে। কী কলকজা। ঘড়ির মধ্যেই ক্যালেন্ডার। ঘড়ির মধ্যেই।
ও হো হো। এই ব্যাপার। এ আর নতুন কী? ও দেশে এটা তো এখন বাতিলের দলে। তা মামা, তুমি এমন বুড়িয়ে গেলে কেন বল তো? রিটায়ার ফিটায়ার করে বসেছ না কি? …ওঃ!
মামী বলল, ছুটির দিনে কাগজ চিবোচ্ছে।
হাহা হা! নাঃ! সেই নেশা? তা এনার্জির এমন অভাব কেন মামা? সেই আদ্যিকালের পিঠ ভাঙা বেতের চেয়ারই চালিয়ে যাচ্ছ। ..কী আর বলব মামা, পৃথিবীটাকে একবার না দেখতে পারলে চোখ তৈরি হয় না। আমাদের এখানে জীবন মানে দিনগত পাপক্ষয়। আর ওদেশে? জীবন মানে হচ্ছে
বন্ধুর জীবনের মানে খোঁজার আলপিন প্রমাণ অবকাশে হরিগোপাল শীতল কণ্ঠে বলেন, আমেরিকা থেকে এলি বুঝি?
অ্যামেরিকা! মানে স্টেটস। নাঃ ওটা এখনও হয়ে ওঠেনি। তবে হওয়াতেই হবে শীগগির। বিজনেসের বেড়াজালে পড়তে যাচ্ছি যখন। তা অতদূরে নয়। এই মিডল ইষ্ট একবার ঘুরে এসো মামা। পাসপোর্টের জন্যে চিন্তা নেই, আমি আছি। দেখে এসো মামা, ভোগ কাকে বলে, রুচি কাকে বলে, বাঁচার মত বাঁচা কাকে বলে। হবে না কেন? সব কিছুরই মূলাধার তো টাকা? টাকা দিয়ে তুমি কী না কিনতে পারো? শুধু বাড়ি গাড়ি আরাম আয়েসই তো নয়, যশ মান খ্যাতি প্রতিষ্ঠা, রুচি কালচার, কী নয়? আর সেই টাকা ওই দেশটার রাস্তার ধূলোয় ছড়ানো। বাতাসে টাকা, আকাশে টাকা। নইলে আমার মত একটা অভাগা বেকারকে ষোলো হাজার টাকা মাস মাইনে দিয়ে পোষে? প্লাশ রাজার হালে রাখা। বাড়ি গাড়ি ফার্নিচার সব ফ্রী।
হরিগোপাল চমকিয়া বলেন, মাসে ষোলো হাজার? তখন হঠাৎ শুনে ভাবলাম বুঝি বছরে?
বছরে? হা হা হা। বছরে ষোলো হাজার ছাপানো তো ওদের ঝাড়দারের মাইনে। বঙ্কিম দমকে দমকে হাসে।
আর তুই সোনার দেশের চাকরী ছেড়ে দিয়ে চলে এলি? প্রশ্নমুখর কণ্ঠ আক্ষেপ বিহ্বল।
পরক্ষণেই সান্ত্বনাঘন উত্তর, তবু চাকরী ইজ চাকরী মামী, চাকরগিরি। দাসত্ব। বিজনেস হচ্ছে স্বাধীন ব্যাপার। তাছাড়া বরাবর তো বাইরে পড়ে থাকা যায় না? মা বুড়ি রয়েছে। আর মাসে ষোলো হাজার আর এমন কী? পার্ক স্ট্রীট পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে নিলাম হাজার আড়াই দিয়ে, সেখানেই নিয়ে রাখবো মাকে। আহা এতদিন পরের বাড়িতে কাশীতে পড়ে আছে। পিসি অবিশ্যি যত্নটত্ন করে। তা আমার তো আকাশে উড়ে উড়েই দিন যাবে, মার জন্যেই ফ্ল্যাট!
হরিগোপাল বলিয়া ওঠেন, তুই উড়ে বেড়াবি, তা মা বুড়ি তোর ওই পার্ক স্ট্রীট পাড়ার আড়াই হাজারি ফ্ল্যাটে একা বাস করতে পারবে?
সেটাই প্রবলেম ছিল, তো ছোটমামা সেটা সম্ভ করে দিয়েছে। উইথ ফ্যামিলি মার কাছে গিয়ে থাকবে।
অ্যাঁ। হরিগোপাল গৃহিণী যেন আছাড় খাইলেন। ক্ষোভে দুঃখে বিস্ময়ে চোখে জল আসিয়া গেল। একটুখানির জন্য চলিয়া আসিয়াছেন তিনি, ইতিমধ্যে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া গেল। ..ছোটগিন্নী সাহেবপাড়ায় দুই হাজারি ফ্ল্যাটে সংসার সাজাইয়া বসিবে, আর তিনি এই পচা পুরনো নোনা ধরা বাড়িখানায় পুরনো জঞ্জালের বোঝা লইয়া পড়িয়া থাকিবেন। উঃ! হইবে না। কেন স্বামী যার বেকুব আহাম্মক, তার আর কী হইবে? মাথা খুঁড়িতে ইচ্ছা হইতেছে।
বন্ধুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই হরিগোপাল যদি ছুটিয়া যাইতেন, এতবড় সিদ্ধান্তটা কী তার অজানিতে লওয়া হইয়া যাইত?
হরিগোপাল অবশ্য আকস্মিক ওই সংবাদে বিচলিত হইলেন না। অগ্রাহ্যের গলায় কহিলেন, দ্বিজু বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে যাবে ডাবুকে আগলাতে? ডাবুর সঙ্গে তো ওর বরাবর আদায় কাঁচকলায়।
ক্ষেত্র বিশেষে আদা কাঁচকলাও আমদুধ হয়ে যায় মামা, ওটা কোনও ব্যাপার নয়। …বন্ধু একটু দার্শনিক হাসি হাসে।
তারপর বলে, তা তুমিও এই পচাপড়া ছেড়ে, আসল কথা পুরনো চশমাটা পালটাতে হবে। দুনিয়াটাকে একবার চোখকান খুলে দেখতে শেখো মামা, দেখবে জলে স্থলে আকাশে বাতাসে সর্বত্র টাকার চাষ চলছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে তার ফসল থেকে খানিক খানিক নিজের গোলায় তোলা, ব্যস। নো চিন্তা!…যাই বল মামী, ছোট মামা অনেক প্রগ্রেসিভ। এক কথায় আমার বিজনেসে পার্টনার হতে রাজী হয়ে গেল। মহা উৎসাহে।