তা মাঝে মাঝেই সে রকম লজ্জায় মর্মাহত হইতে হয় বৈকি বন্ধুকে। যে সব জিনিসগুলা খাইয়া ফেলিবার নয়। মাখিয়া উড়াইয়া দিবার, সেই সবেও যদি মামা মামীর অনিচ্ছুক ভাব দেখা যায় মর্মাহত হওয়াটা তো স্বাভাবিকই।…বন্ধু যদি বড় মামার দামী শাল খানা গায়ে দিয়া মাঝে মাঝে বন্ধুর দাদার বৌভাত, অথবা বন্ধুর বোনের বিয়েতে নিমন্ত্রণ খাইয়া আসে, ইয়া যাইবে সেটা? …অথবা বন্ধুদের সহিত দুই দশদিনের জন্য কোথাও বেড়াইতে যাওয়ার প্রাক্কালে ছোটমামার সৌখিন পুলওভার, সোয়েটারও শখের অ্যারিস্টোক্র্যাট সুটকেসটা সংগ্রহ করিয়া লইয়া যায়, মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইবে? ভাল জিনিস তো দেখাইবার জন্যই। তা সে বোধ কোথায়?
বন্ধু নিজ উদারতার বশে কিছু মাইণ্ড করে না তাই! অন্য ভাগিনেয় হইলে হয়তো এই সূত্রেই মামাদের সহিত চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়া যাইত।…কথাতেই তো আছে জন জামাই ভাগনা তিন হয়না আপনা।
বন্ধু নিজগুণে আপন। তাই মামামামীর সংকীর্ণতা ক্ষমা করিয়া নিজেই সে সেইসব টানিয়া বাহির করিয়া ঝাড়িয়া ঝাড়িয়া লইয়া যায়।
এই বঙ্কিমবিহারী। ওরফে বঙ্কা।
তবে অন্য একটা দিকও কি নাই বন্ধুর? মানে হারাইয়া যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত অবধি ছিল না? মামাদের সংসারে যখন যে সমস্যা আসুক বন্ধু তাহার সমাধানে একপায়ে খাড়া থাকিত না?
কোন্ দুষ্প্রাপ্য জিনিসটি কোথায় প্রাপ্তব্য, কোন্ বাজারে কোন জিনিসটি সস্তা, কাহাকে ধরিতে পারিলে, একদিনে ট্রেনের রিজার্ভেশান হইয়া যায়, কোথায় টোপ ফেলিলে টেস্ট ম্যাচের সীজন টিকিটও হাতে আসিতে পারে, এসব বন্ধুর নখদর্পণে। যে ছিদ্রে ছুঁচ চলে না, বন্ধু সেখানে ফাল চালাইতে সক্ষম। ট্যাক্সি ভাড়ার টাকাটা অবশ্য লাগে। তা টাকা আর কিসে না লাগে?
মামীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পথ মসৃণ রাখিতেই কি বন্ধুর কম অবদান ছিল? …পাম্প, ইলেকট্রিক, টি ভি, টেলিফোন, হিটার, প্রেসার কুকার, জলের কল, সেলাইকল, বেসিন সিসটার্ন, ইত্যাদি করিয়া সংসারের প্রতিটি প্রাণহীন প্রাণীই তো প্রতিনিয়তই খারাপ হইয়া যাইবার জন্য উন্মুখ হইয়া থাকে। খারাপ হয়। অতএব সর্বদাই কাহাকেও না কাহাকে সুস্থজীবনে ফিরাইয়া আনার প্রয়োজন ঘটে। …তখন? তখন বন্ধু ছাড়া গতি কোথায়?
কিন্তু বন্ধু কি সর্ববিদ্যা বিশারদ?
তা অবশ্যই নয়। যাহারা বিশারদ, তাহারাই আসিয়া যা করিবার করিয়া দিয়া যায়। বন্ধু শুধু তাহাদের ডাকিয়া আনে।…তা কৃতিত্ব তো সেই খানেই। মিস্ত্রী নামক জীবনযাত্রা রক্ষক শিল্পী দিগের সংবিধানে এমন কথা লেখা নাই যে, ডাকিলেই আসিতে হইবে।
ডাকার মত ডাকা চাই। কিন্তু ওই ডাকার মত ডাকিবার ক্ষমতা কজনের থাকে?…কাজেই ডাক দিয়া দিয়া জুতা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে ইচ্ছা হয়, অগত্যাই তখন বন্ধু।
মামীরা এতদিন অসুবিধাভোগ করিতেছে জানিতে পারিলে, অভিমানহত বন্ধু মামাদের দুইকথা শুনাইয়া দিয়া তদ্দণ্ডে বাহির হইয়া যায়, এবং অভীষ্ট ব্যক্তিকে তখনই আনিয়া হাজির করে।
কোন্ মহামন্ত্রে?
গৃহিণীদের এই তীব্র প্রশ্নের উত্তরে হতমান্য মামারা বিরক্ত উত্তর দেন, মাইডিয়ারী মন্ত্রে! আবার কী? আমাদের দ্বারা তো আর তা হবে না। কিন্তু এত করিৎকর্মা বঙ্কিমবিহারীর একটা চাকরী কেন জোটে না?
তার জন্য বন্ধু মামাদেরই দায়ী করে। বলে চিরদিন শুনে আসছি মামা দাদার খুঁটির জোরে চাকরী মেলে। তা হতভাগা বঙ্কিমের দাদার বালাই নেই, মামারা থেকেও নেই। আমার এই বেকার হয়ে পড়ে থাকা যে তোমাদেরই অপযশ মামা, তা যদি বুঝতে!
কথা। কথা। অহরহ কথার চাষ। সেই চাষের ফসলেই বন্ধুর দিন গুজরাণ!…কিন্তু এ সমস্তই তো গত কথা। পাঁচ বছর আগের ওপারের কথা।
.
পাঁচ বছর পূর্বে এমনি এক শীতের সকালে রোদের দালানে বসিয়া ডিমভাজা সহযোগে চা খাইতে খাইতে বন্ধু যখন বলিতেছিল, তোমাদের এই বাড়িটা মামী এত আরামের।
শীত গ্রীষ্ম সব সীজনে আরাম, তখন সহসা তার কানে আসিল হরিগোপালের হাত ঘড়িটার কাটা আটকাইয়া গিয়াছে। শোনামাত্র বন্ধুর আরামের গলায় কাঁটা বিধিয়া গেল। লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, তাই নাকি? দাও এক্ষুনি ঠিক করে আনছি–
বলিয়া মামার হাত হইতে ঘড়িটা প্রায় ছিনাইয়া লইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। গেল তো গেলই। আর ফিরিল না।
সেই বন্ধুর মহানিষ্ক্রমণ।
পাঁচ পাঁচটা বছর বন্ধুর কোনও পাত্তা নাই। …অতঃপর এই আলৌকিক নাটকীয় আবির্ভাব।
এ আবির্ভাব শুধু নাটকীয়ই নয়, রাজকীয়ও। কারণ টুলি জ্যাঠাকে কলা দেখাইয়া চলিয়া যাইবার পরক্ষণেই জয়গোপাল দ্রুত ব্যস্ততায় ছুটিয়া আসিয়া কহিল, বাবা, তুমি একবার গেলে না? বন্ধুদা এসেই তোমায় খুঁজেছে। কাগজ পড়াটাই এত ইমপর্ট্যান্ট হল। আশ্চর্য! ওদিকে কাকা
যেমন বেগে প্রবেশ, তেমনি বেগেই প্রস্থান।
হরিগোপাল ধীরে সুস্থে কাগজগুলা ভাঁজ করিয়া, উঠিয়া পা বাড়াইতেছেন, টুলির জ্যাঠাইমা আসিলেন আরক্ত মুখে, এই শীতেও হাঁপাইতে হাঁপাইতে।
আচ্ছা। তুমি কী গো? ছেলেটা কতক্ষণ হল এসেছে, বড়মামা বড়মামা করে হাঁপাচ্ছে, আর তুমি! ছিঃ! কতকাল পরে এল বেচারী!
হরিগোপাল কহিলেন, মামী তো একাই একশো! মামার জন্যে কী? তা ঘড়িটার কথা জিগ্যেস করেছ?