বঙ্কিমবিহারীর কি আর এ মনোভঙ্গী, বুঝিবার ক্ষমতা ছিল না? ছিল বইকি! পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্গত বিষয়সমূহ ব্যতীত জগতের অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ই, মুহূর্তে বুঝিয়া ফেলিবার ক্ষমতা ছিল তাহার। তবে আরও একটি ক্ষমতাও আশ্চর্য রকমের ছিল, সেটি হইতেছে অবহেলা পরিপাক করিবার ক্ষমতা।… সে অবহেলা যত দুষ্পচ্যই হোক, বঙ্কা সেটি এমন অনায়াস নিপুণতায় হজম করিতে পারিত, দেখিলে তাক লাগিবার মত।
বঙ্কা উত্তরমাত্র না পাইয়াও, বুঝলে ছোটমামা সম্বোধনে দ্বিজগোপালকে উদ্দেশ করিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল কথা চালাইয়া যাইতে পারিত, (দ্বিজগোপাল স্থান পরিবর্তন করিলে সেও পিছু পিছু চলিত)। নিতান্ত অনিচ্ছুক বেজারবদনা ছোটমামীকে দিয়াই একাধিকবার চা আদায় করিয়া ছাড়িত এবং কস্মিনকালেও নিমন্ত্রণ না পাইলেও যখন তখন মামারবাড়ি আসিয়া দুই চারদিন কাটাইয়া যাইতে পারিত।…আর যে বড়মামী তাহাকে আসিতে দেখিলেই সশব্দ স্বগতোক্তি করিতেন, ওই যে আবার এসে উদয় হলেন। সেই বড়মামীকে দিয়াই নানাবিধ রসনা সুখকর আহার্য বস্তু রন্ধন করাইয়া, কব্জি ডুবাইয়া খাইয়া লইতে লজ্জা করিত না।
পদ্ধতি নিম্নলিখিত
প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্কার উদাত্ত কণ্ঠ ছাদ ভেদ করিত, মামী বাড়ি আছো? না বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছো?
অতঃপর তাহার বক্তব্যের ভঙ্গী এইরূপ।
তোমার ননদের হাতের ঝালের ঝোল আর বড়ি চচ্চড়ি খেতে খেতে লাইফ মিজারেবল হয়ে গেল মামী! চলে এলাম তোমার কাছে।… কী রান্না করছ? দারুণ সৌরভ পাচ্ছি। আহা মামী তোমার রান্না ঘরের সৌরভই আলাদা। আর তোমার ননদের? আহা!
মামী মনের কথা মনে রাখিয়া বেজার গলায় বলেন, তা তোর মা তোকেও জন্মের শোধ বড়ি চচ্চড়ির হেঁশেলে ভর্তি করে রেখেছে কেন? আলাদা করে একটু মাছ ফাচ বেঁধে দিতে পারে না?
হা হা হা। হাসালে মামী। বেকারের জন্যে আবার আলাদা। তাহলে ওই ফাচই হবে। মাছ নয়। যাকগে তুমি রাঁধো, ততক্ষণ একটু চা খাওয়া যাক।…ছোটমামী, ঘুমোচ্ছো না কি? একটু চা বানাও তো চটপট। সকাল থেকে দু কাপ বৈ জোটেনি।
আবার গলা শোনা যায় বন্ধুর, আচ্ছা ছোটমামী, তুমি এত কুঁড়ে কেন বল তো? বড় মামী যতক্ষণে মাংস বেঁধে ফেলে তুমি ততক্ষণে একটু চা বানাও। আশ্চর্য!
আবার হয় তো বা কোনও দিন রান্না ঘরে উঁকি মারিয়াই বলিয়া ওঠে, হোপলেস। আজ বাজার গিয়েছিল কে? ছোটমামা বুঝি?…টাকা ছাড়ো মামী মাংস নিয়ে আসি। …কী বলছো? এত বেলায় আর মাংস রাঁধা যাবে না? যাক গে বেশ জম্পেশ করে ডিমের ডালনাই চড়িয়ে দাও না হয়। মাংস কাল খাওয়া যাবে। মুর্গি ফুর্গি যে এখনও অছুৎ করে রেখেছ ছাই। ওই রাঁধতে বেশী সময় লাগে না।…কই গো ছোট মামী চা বানাতে যে বুড়ো হয়ে গেলে। চায়ের সঙ্গে টা টা একটু জোরদার কোরো বাপু। সকাল থেকে ঘুরছি। …বন্ধু বলল, তোর আর কি! চলে যা। মামার বাড়ি।
.
অবশ্য কেবলমাত্র খাওয়া দাওয়া ব্যাপারেই যে মামার বাড়ির আবদার সীমাবদ্ধ থাকিত, তাহা নহে, আবদারের পরিধি ছিল বিশাল বিস্মৃত। হতভাগা বেকার বলিয়া কি বন্ধুর প্রাণে কিছু সাধ বাসনা থাকিতে পারে না? কিন্তু সে বাসনা মিটাইতে যার তার কাছে ধারকর্জ করিয়া কি বন্ধু তাহার এমন মান্যগণ্য মামাদের সম্ভ্রম নষ্ট করিবে?…আর বন্ধু যদি তালিমারা জুতা, কাটা ওঠা চটি, আর ঘসা পয়সার মত শার্ট প্যান্ট পরিয়া বেড়ায়? তাহাতেও তো মামাদের মুখ হেঁট। …বন্ধু অভাগার ভাগ্যে যে মাটিও হাড় কেল্পন। এমন দিলদরিয়া ভাইদের অমন বোন। আশ্চর্য।
.
শহরে যে কোনও হলে নতুন ছবি আসিলেই বন্ধুর টনক নড়ে। ..রান্নাঘরের পোকা মামীদের টানিয়া বাহির করিবার জন্য সাধ্য সাধনার সাধনা চালায়। মামীরা লোভের বশে কখনও যে ফাঁদে পা দেন না, তাহা নয়, তবে কখনও কখনও সাবধানও হন। ছবি দেখার বিরুদ্ধে নানান অজুহাত দেখান। ..অতএব বন্ধু এই ঘোরতর সংসারীদিগকে ধিক্কার দিয়া চলিয়া যায়, এবং চলিয়া যাইবার আগে বলিয়া যায়, মামার পকেট থেকে গোটাকতক টাকা না বলে চেয়ে নিয়ে গেলাম মামী। খোঁজ পড়ে তো বোলো, নচেৎ লোকজনের ওপর সন্দেহ পড়তে পারে। খোঁজ না পড়লে চেপে যেও।
মামী যদি ছুটিয়া আসিয়া প্রশ্ন করেন, তা কত নিলি শুনি?
বঙ্কিমবিহারী সরলহাস্যে বলে, সেটা চেপে গেলাম। চেপে যাওয়াই হচ্ছে শান্তি বজায়ের প্রধান উপায়। বুঝলে মামী!
তা শুধুই কি আলনায় ঝোলানো জামা প্যান্টের পকেটের টাকা? …যে কোনও জিনিসই না বলিয়া চাহিয়া লওয়ার অভ্যাস বন্ধুর মজ্জাগত মুদ্রাদোষ। কিন্তু মুদ্রাদোষ কি দোষের পর্যায়ে পড়ে? বন্ধুর অন্তত তেমন কুসংস্কার নাই। দরকার পড়া জিনিসপত্র হাতের কাছে পড়িয়া থাকিতে দেখিলেও, বন্ধু সেই সব বস্তুগুলি আহরণ করিতে দোকানে ছুটিবে কেন, এটা বন্ধুর আবোধ্য। …কী বা জিনিস। তুচ্ছাতিতুচ্ছ। ব্লেড, শেভিং ব্রাশ। সাবান শ্যাম্পু, আফটার শেভিং লোশান, কি তেল চিরুণী ক্রীম পাউডার, অথবা একটা টর্চ, ডটপেন, এ সব কি আবার ধর্তব্য? দরকার পড়িলে উঠাইয়া লইয়া পকেটে পোরায় লজ্জার কিছুই দেখে না বন্ধু। বরং লজ্জিত হয় মামারবাড়ির কাহারো মুখে তাহার উল্লেখ শুনিলে। লজ্জা–মাতুকুলের অনুদারতায়।